English

34 C
Dhaka
শুক্রবার, এপ্রিল ১৯, ২০২৪
- Advertisement -

বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ নিয়ে আইন যা রয়েছে

- Advertisements -

২০১৯ সালের মার্চ মাসে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া এলাকায় দুই পুলিশ সদস্যের হাতে ধর্ষণের শিকার এক নারীকে কেন ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিল হাইকোর্ট। সেসময় স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও এ ঘটনাটি উঠে আসে।
চিলড্রেন চ্যারিটি বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ লিগাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট নামে দুটি সংগঠন জনস্বার্থে একটি রিট করলে সেই রিটের শুনানির পর এই রুল জারি করা হয়েছিল।
তবে এ বিষয়ে ধর্ষণের শিকার ওই নারী আর রিট মামলাটি এগিয়ে নিতে রাজি না হওয়ায় সেটি আর এগোয়নি বলে জানান বাংলাদেশ লিগাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্ট এর গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবির হুদা। বাংলাদেশে ধর্ষণ আইনের সংস্কারের দাবিতে পরিচালিত একটি ক্যাম্পেইন “রেপ ল রিফর্ম নাও” এর নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট মামলার ঘটনা এটাই প্রথম ছিল।
বাংলাদেশ লিগাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্টের করা এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় নিষ্পত্তি হওয়া ৫০টি মামলার মধ্যে মাত্র ৩টি মামলায় জরিমানার অর্থকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করার আদেশ দেয় আদালত। শতাংশের হিসেবে যা মাত্র ৬%।
অনেকেই মনে করেন যে, ধর্ষণের ঘটনায় কোন অংকের অর্থ দিয়েই আসলে ক্ষতিপূরণ করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সাজাই একমাত্র সমাধান।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় ভুক্তভোগীর মানসিক উন্নয়ন এবং পরবর্তীতে তার পুনর্বাসনের মতো বিষয়গুলো জরুরী হয়ে দাঁড়ায়।
এছাড়া মামলা পরিচালনার খরচ, সুচিকিৎসার মতো বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেয়া উচিত বলে মনে করেন তারা।
মি হুদা বলেন, “ধর্ষণের ক্ষেত্রে যে শুধু অপরাধ-কালীন সাজা সেটা নয়, বরং ধর্ষণের শিকার যে ব্যক্তি তার যে একটা পুনর্গঠনের এবং পুনর্বাসনের বিষয় আছে, তাকে যে প্রতিকার দেয়ার একটা কথা আছে এ ধরনের কোন ধারণাই আমাদের নাই। আমরা ধর্ষণ হলেই মনে করি যে সাজা হতে হবে।”
তিনি বলেন, এসিড সন্ত্রাস, বাল্যবিবাহের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার নিয়ম থাকলে ধর্ষণের ক্ষেত্রেও সেটি প্রযোজ্যও হওয়া উচিত। এছাড়া ধর্ষক এবং ধর্ষণের শিকার- এই দুই পক্ষের মধ্যে বরাবরই ক্ষমতার অসমতা থাকে।
আইনে কী আছে?
২০০০ সালের আগে ধর্ষণের ঘটনায় জরিমানার বিষয়টি বাধ্যতামূলক ছিল না। ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে জরিমানা বাধ্যতামূলক করা হয়।
এই আইনে বলা হয় যে, “যদি কোন ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তাহার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহা হইলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হবেন।”
এছাড়া যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন এবং ধর্ষণের ফলে উক্ত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন তাহলে ঐ দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন।
যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করে বা আহত করার চেষ্টা করে তাহলে তার যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হবে। আর ধর্ষণের চেষ্টা করলে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, ধর্ষক বা অপরাধীকেই জরিমানার এই অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে অপরাধীর স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি বিক্রি বা নিলাম করেও জরিমানা আদায়ের কথা আইনে বলা হয়েছে।
আইনের ফাঁক কোথায়?
তবে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনেও ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে কিছু সমস্যা রয়েছে বলে মনে করেন অ্যাক্টিভিস্টরা।
এ বিষয়ে ব্লাস্টের গবেষণা বিশেষজ্ঞ তাকবির হুদা বলেন, বর্তমানে ধর্ষণ বিষয়ক আইনটিতে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কারভাবে কিছু উল্লেখ করা নেই।
তার মতে, এই আইনে অর্থদণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে অর্থাৎ কোন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অর্থদণ্ড দিতে হবে। কিন্তু সেটি ক্ষতিপূরণ হিসেবে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে দেয়া হবে কিনা সে বিষয়টি উল্লেখ নেই।
তিনি বলেন, “এই আইন অনুযায়ী, ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি ক্ষতিপূরণ পাবে কিনা সে বিষয়টি পুরোপুরি বিচারক তথা আদালতের উপর নির্ভর করে।
“এখানে যে ঘাটতি রয়ে গেছে তা হল, আমরাতো জানি জরিমানাটা রাষ্ট্রের কাছে যায়। জরিমানা যদি ভুক্তভোগীর কাছে যেতে হয়, তাহলে আদালতকে এটাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কনভার্ট করতে হয়। অর্ডার অব ফাইনকে রূপান্তরিত করতে হয় অর্ডার অব কম্পেনসেশনে। এটা বিচারকদের একটা বিবেচনার বিষয়।”
তবে অধিকাংশ মামলায় জরিমানার অর্থকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে গণ্য করার নির্দেশ আসে না বলেও জানান তিনি।
মি. হুদা বলেন, “নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১৫ ধারায় ট্রাইব্যুনাল ক্ষতিপূরণ দেয়ার যে ক্ষমতা বিচারকদেরকে দেয়া হয়েছে তা খুব স্বল্প পরিমাণ মামলার ক্ষেত্রে প্র্যাকটিস করা হচ্ছে।”
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, এই আইনটির দুর্বলতা হচ্ছে, ভুক্তভোগীকে ক্ষতিপূরণের অর্থ পেতে হলে মামলা পুরোপুরি নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় যা বেশ লম্বা প্রক্রিয়া।
তিনি বলেন, জরিমানার যে অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেয়া হয় সেটি চলে যায় সংশ্লিষ্ট জেলার কালেক্টরেটের অফিসে। সেখান থেকে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তবেই ভুক্তভোগী ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়ে থাকে।
ক্ষতিপূরণের অর্থ দ্রুত ভুক্তভোগীর পাওয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলেও মনে করেন সালমা আলী।
সমাধান কী হতে পারে?
বাল্যবিবাহ, মানব পাচার এবং এসিড সন্ত্রাসের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে আলাদা আইন রয়েছে। তাহলে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের পাওয়া নিশ্চিত করতে কি আরেকটি আইন দরকার। বিশেষজ্ঞরা সেটি মনে করছেন না। বরং তারা বলছেন যে, বিদ্যমান আইনেই কিছু সংস্কার এনে এই বিষয়টি নিশ্চিত করা সম্ভব।
এ বিষয়ে মি. হুদা বলেন, অন্য বিষয়গুলোতে আলাদা আইন করেই যে সে অপরাধগুলো নিশ্চিহ্ন করা গেছে তা কিন্তু নয়।
ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ের সুপারিশ করেছেন তারা।
এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, বিদ্যমান আইনে অর্থদণ্ডের পাশাপাশি সেই অর্থ ক্ষতিপূরণ হিসেবে ভুক্তভোগীকে দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বিচারকদেরকে জরিমানাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে রূপান্তরের যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে তার ব্যবহার আরও বেশি বাড়াতে হবে। সেক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে এ ধরণের মামলার ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে।
তৃতীয়ত, ভুক্তভোগীর কাছে ক্ষতিপূরণের অর্থ একাধিক উৎস থেকে আসা উচিত। শুধু অপরাধী নয় বরং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণের একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত।
মি. হুদা বলেন, উন্নত দেশগুলোতে রাষ্ট্রীয় একটা তহবিল থাকে যেখান থেকে নিষ্ঠুর অপরাধের শিকার ব্যক্তিরা ক্ষতিপূরণ পেতে পারে। বাংলাদেশেও এ ধরণের ব্যবস্থা থাকা উচিত যাতে ভুক্তভোগীরা বিচার শেষে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে।প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এ ধরণের ব্যবস্থা রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলি ভারতের একটি রেলস্টেশনে এক বাংলাদেশি নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার ঘটনা উল্লেখ করে বলেন, ওই ঘটনায় রেল কর্তৃপক্ষ ওই নারীকে ২০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল আদালতের নির্দেশে। কারণ, ওই নারীর নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রেল কর্তৃপক্ষের উপরও কিছুটা বর্তায় এবং ঘটনা খোদ রেলস্টেশনে হয়েছিল।
বাংলাদেশে এ ধরণের কোন আইনি ধারা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে।
এক্ষেত্রে তিনি সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে এক নারীকে ধর্ষণের ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, এ ধরণের ঘটনার দায় ওই কলেজ কর্তৃপক্ষেরও রয়েছে।
একই ধরণের মত দিয়েছেন মি. হুদাও। তিনি বলেন, অনেক সময় তৃতীয় কোন পক্ষের গাফিলতির কারণে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে। যেমন ধর্ষণ যদি কোন হোটেলে ঘটে থাকে বা এমন কোন জায়গায় যেখানে তার সুরক্ষার দায়িত্ব ওই কর্তৃপক্ষের থাকে যেমন কর্মক্ষেত্র- সেখানে সেই কর্তৃপক্ষকেও এ ধরণের অপরাধের ক্ষেত্রে দায় নিতে হবে। ক্ষতিপূরণ এ ধরণের উৎস থেকেও আসতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
টর্ট বা দেওয়ানি আইনের অধীনে এ বিষয়ে সমাধান আসতে পারে বলে জানান তিনি।
তবে এ বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, একজন ধর্ষকের শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতিপূরণ দিয়েই তার বিচার শেষ হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। বরং ধর্ষকের সাজা হবে এবং পাশাপাশি অর্থদণ্ড থাকবে।
তবে হত দরিদ্র কেউ ধর্ষণের মতো ঘটনার শিকার হলে সেটি সরকারের নজরে আসে এবং সরকার সেই সহযোগিতা দেয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
“আইনের মধ্যে তাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, তাহলে তো যেকোন সময় যেকোন ঘটনা সত্য কি মিথ্যা ঘটিয়েই চলে আসবে যে আমাকে ক্ষতিপূরণ দেন। সেটা তো সম্ভব না। এটা প্রমাণ সাপেক্ষ বিষয়।”
তবে অপরাধ প্রমাণিত হলে সে সমাজ এবং সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা পায় বলেও দাবি করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব
Notify of
guest
0 মন্তব্য
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন