অনেক প্রথমের “মা”
ছোট খাটো চেহারার এই অতি মেধাবী ছাত্রীটির ইচ্ছে ছিল বায়ো-টেকনোলজি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার কিন্তু ভারতের যে কলেজ সে পড়তো সেই কলেজে তখন সেরকম কিছু পড়ানোই হতো না। অগত্যা “হোম সাইন্স” নিয়ে গ্রাজুয়েশন। বাবা-দাদা-রা মজা করে বলতেন “হোম সাইন্স” সাবজেক্টে আসলে ঠিক কী শেখানো হয় ? বাসন মাজা ? মনে মনে দুঃখ পেলেও মেয়েটি চুপ করে শুনতো।
এরপর একটি পত্রিকাতে সে আবিষ্কার করে আমেরিকাতে বায়ো-টেকনোলজি পড়ানো হয়। কাউকে কিছু না জানিয়ে সে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য আবেদন পত্র পাঠিয়ে দেয়। কি আশ্চর্য,ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া -বার্কলে থেকে তার ডাক আসে। এরকম বিশ্ব-বিখ্যাত আমেরিকান ইউনিভার্সিটি তাকে ডাক পাঠিয়েছে শুনে অবাক হয়ে যান তার বাবা-দাদা-রাও!
তাদের অতি রক্ষণশীল তামিল পরিবারে কেউ কখনো ভারতের বাইরে পা রাখেনি, তাই পরিবারের পক্ষ থেকে আসে প্রবল আপত্তি। কিন্তু বাবা, মেয়ের পক্ষ নেন এবং বলেন যে তার কাছে যা টাকা- পয়সা আছে তা দিয়ে খুব জোর এক বছরের পড়াশুনোর খরচ চলবে, বাকিটা তিনি জানেন না। মেয়েটি বলে সেটাই যথেষ্ট । বাকি পড়ার খরচ তিনি পার্ট টাইম চাকরি করে জোগাড় করবেন।
১৯৫৯ সালে ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া-বার্কলের এডমিশনের লাইনে যে শাড়ি, হাওয়াই চটি পরা মেয়েটি দাঁড়িয়েছিল, তার একটু পিছনেই দাঁড়িয়েছিল আর একটি বিদেশী ছাত্র – জ্যামাইকান এই কালো ছেলেটির নাম ডোনাল্ড হ্যারিস। সে স্কলারশিপ পেয়ে অর্থনীতিতে পিএইচডি করতে এসেছে। আমেরিকার রাজনীতিতে সে এক ভীষণ টালমাটাল সময়। কালো মানুষদের অধিকারের জন্য সারা আমেরিকা জুড়ে শুরু হয়ে গেছে “সিভিল রাইটস মুভমেন্ট”।
১৯৬০ সালে একটি স্টুডেন্ট ফোরামে কালো মানুষদের অধিকারের সপক্ষে একটি অসাধারণ বক্তৃতা দেন ডোনাল্ড হ্যারিস। বক্তৃতার শেষে মুগ্ধ, সেই শাড়ি পরা মেয়েটি, ডোনাল্ড হ্যারিসের সঙ্গে নিজেই আলাপ করে। প্রথম আলাপেই প্রেম আর ১৯৬৩ সালে বিয়ে। ভারতীয় মেয়েটি বিয়ের পর শ্যামলা গোপালন থেকে হয়ে যান শ্যামলা হ্যারিস।
এর পর জন্মায় তাদের প্রথম সন্তান – মেয়েটির নাম রাখেন “কমলা দেবী” – দেবী লক্ষ্মীর নামে নাম মিলিয়ে !
আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্টে ভীষণ ভাবে জড়িয়ে পড়েন শ্যামলা ও ডোনাল্ড হ্যারিস। সেই প্রতিবাদ মিছিলের ভিড়ে, শিশু কন্যাটি পারাম্বুলেটরে বসে বসে দেখেছিলো তার বাবার বক্তৃতা, মায়ের আন্দোলন।
পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সেই ঐতিহাসিক ঘটনা- ডক্টর মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে আমেরিকাতে কালো মানুষদের অধিকারের লড়াই ও তাতে জয়লাভ।
সে লড়াই থামতে না থামতেই শুরু হয় শ্যামলা হ্যারিসের নিজের জীবনের লড়াই।
১৯৭০ সালে দুটি শিশু কন্যা নিয়ে ডিভোর্সড, সিঙ্গেল মাদারের সে লড়াইটা ছিল একা এবং ব্যক্তিগত।
পিএইচডি শেষ করে শ্যামলা হ্যারিস শুরু করেন ব্রেস্ট ক্যান্সার নিয়ে গবেষণা। গবেষক হিসেবে তার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পরে সারা পৃথিবীতে। গবেষণার কাজে প্রায় অর্ধেক পৃথিবী ঘুরে ফেলেন এই পাঁচ ফুট উচ্চতার ছোট্ট খাট্টো ডক্টর শ্যামলা হ্যারিস।
শিশু কন্যা দুটি কে কখনো ডে কেয়ার-এ রেখে, কখনো বন্ধুর বাড়িতে রেখে নিজের পড়াশুনো, গবেষণা, চাকরি চালিয়ে গেছেন শ্যামলা। একটু মানসিক শান্তির জন্য মেয়েদের নিয়ে গেছেন কখনো চার্চে, কখনো মন্দিরে। তাদের শিখিয়েছেন রান্না করতে, নিজেদের কাজ নিজে করতে। আর শিখিয়েছেন নিজের অধিকারের জন্য লড়াই করতে।
পারাম্বুলেটরে বসে বসে যে মেয়েটি আমেরিকার সব চেয়ে বড় অধিকারের লড়াইটা দেখেছিলো, দেখেছিলো নিজের মায়ের ব্যক্তিগত জীবনের আপোষহীন লড়াই, সেই ছোট্ট মেয়েটাই আজ নামকরা আইনজীবী ও আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট – কমলা দেবী হ্যারিস !
অনেক কিছুতে-ই প্রথম কমলা দেবী হ্যারিস !
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাইস*প্রেসিডেন্ট !
প্রথম নারী !
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ !
প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত !
তিনি গড়লেন নতুন এক ইতিহাস।
এই ঐতিহাসিক জয়ের পর কমলা হ্যারিস তার মা সম্পর্কে কী বললেন ? বললেন, মা-ই তাকে শিখিয়েছেন “বাড়িতে বসে থেকে অভিযোগের পর অভিযোগ না করে বরং মাঠে নেমে লড়াইটা করো”।
কমলা হ্যারিসকে নিয়ে যখন আমেরিকাতে মাতামাতি (তার উইকিপিডিয়া পেজটি এর মধ্যে ৪৮০ বার এডিট হয়েছে) তখন ছোট কন্যা – মায়া হ্যারিস আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন:
“You can’t know who Kamala Harris is without knowing who our mother was.”
দুটি শিশু কন্যা কে নিয়ে একা এক ভারতীয় সিঙ্গেল মম, শ্যমলা গোপালন সেদিন ঘরের এবং বাইরের তীব্র লড়াইটা না লড়লে, আমেরিকানরা কি তাদের ইতিহাসে প্রথম মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্টটিকে পেত ?
অনেক প্রথমের মা বলেছিলেন: ‘বাড়িতে বসে থেকে অভিযোগের পর অভিযোগ না করে মাঠে নেমে লড়াইটা করো’
The short URL of the present article is: https://www.nirapadnews.com/94q6
সাবস্ক্রাইব
নিরাপদ নিউজ আইডি দিয়ে লগইন করুন
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন