English

31 C
Dhaka
শনিবার, এপ্রিল ২৭, ২০২৪
- Advertisement -

দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী ও ভাষাসৈনিক মুর্তজা বশীর-এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

- Advertisements -

দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী ও ভাষাসৈনিক মুর্তজা বশীর-এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট, করোনায় আক্রান্ত হয়ে ঢাকায়, মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর। প্রয়াত এই গুণি মানুষটির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা এবং তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।

মুর্তজা বশীর ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট, ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত ভাষাবিদ জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ এবং মা মরগুবা খাতুন। তিনি ১৯৪৯ সালে বগুড়া করনেশন ইন্সটিটিউট থেকে মেট্রিক পাস করেন। শৈশব থেকেই ছবি আঁকার প্রতি তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। ১৯৪৭ সালে, মুর্তজা বশীর যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখনই তিনি আকৃষ্ট হন বামপন্থী রাজনীতির প্রতি। ছাত্র ফেডারেশনের সদস্য হিসেবে আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হন। ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে, বগুড়া শহরে আন্দোলনের জন্য বেশ কয়েকটি মিছিল এবং মিটিং আয়োজনে কাজ করেছিলেন।

১৯৪৯ সালে ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনষ্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট)-এ দ্বিতীয় ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে মুর্তজা বশীর চারুকলা শিক্ষা শুরু করেন। তিনি ভাষা আন্দোলনের জন্য অনেক কার্টুন এবং ফেস্টুন এঁকেছেন। ১৯৫০ সালে ৫ মাস কারাভোগ করেছিলেন তিনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

Advertisements

১৯৫৪ সালে পাঁচ বছর মেয়াদী শিল্পশিক্ষা শেষ করে প্রথম বিভাগে পাস করেন মুর্তজা বশীর। ফাইন আর্টের চূড়ান্ত পরীক্ষার ফলাফল বেরোবার আগেই তিনি কলকাতায় আশুতোষ মিউজিয়ামে চার মাসের একটি আর্ট অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে যোগ দেন। পাস করার পর, বছর খানেক ‘নবাবপুর সরকারি স্কুলে’ ড্রয়িং শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইতালির ফ্লোরেন্সে যান। ‘আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টি’তে এক বছর ‘চিত্রকলা’ এবং আরেক বছর ‘ফ্রেসকো’ নিয়ে পড়াশোনা করেন।

এ সময় অধ্যাপক কাপুকিনি ছিলেন তাঁর শিক্ষক। ফ্লোরেন্সে রেনেসাঁর ঐতিহ্য তাঁকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করে। ফ্লোরেন্সে তিনি পথে-প্রান্তরে দেখা সাধারণ মানুষের ছবি এঁকেছেন। মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ফ্লোরেন্সে ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল ‘লা পার্মানেন্ট’ গ্যালারীতে। ইতালিতে দু’বছর কাটিয়ে ১৯৫৮ সালের শেষদিকে তিনি লন্ডন হয়ে দেশে ফেরেন।

মুর্তজা বশীর মূলত চিত্রশিল্পী হলেও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়ও তিনি বিচরণ করেছেন। বিশেষ করে সাহিত্য সাধনায় এবং চলচ্চিত্রশিল্পে তিনি অনেকটা সময় সক্রিয় থেকেছেন ও সৃজনশীল প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। একসময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তিনি। চলচ্চিত্রে সমাজ বাস্তবতা ও শিল্পীত রুচির স্বাক্ষর রেখেছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে।

চিত্রালী সম্পাদক এস এম পারভেজ পরিচালিত ‘কারওয়াঁ’ (১৯৬৪) চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন মুর্তজা বশীর। সাদেক খান পরিচালিত ‘নদী ও নারী’ (১৯৬৫) চলচ্চিত্রের সঙ্গে তিনি আদ্যোপান্ত জড়িয়ে ছিলেন। এই ছবিতে তিনি একাধারে কাজ করেছেন, চিত্রনাট্য-সংলাপ লেখক, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে। সাদেক খান পরিচালিত ‘ক্যায়সে কহু’ (১৯৬৫) চলচ্চিত্রের শিল্প নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। ১৯৬৫ সালের দিকে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেন। এই ছবির চিত্রনাট্য ও সংলাপ লেখার দায়িত্ব পেয়েছিলেন মুর্তজা বশীর। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য এফডিসি’তে জমাও দেয়া হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তিতে এই ছবিটি আর হয়নি। নিজের কাহিনী-চিত্রনাট্যে ‘আকাশের নীল রং’ নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনার কথা ছিল মুর্তজা বশীরের। কিছু কাজও হয়েছিল, ‘নদী ও নারী’ ছবিটি শেষ হওয়ার পর সুটিং হবার কথা ছিল, কিন্তু শেষপর্যন্ত তা আর হয়নি।

এসব চলচ্চিত্রে কাজ করার পূর্বে ১৯৬১ সালে মুর্তজা বশীর লাহোরে থাকাকালীন সময়ে, চলচ্চিত্রকার ডাব্লিউ. জেড. আহমেদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনের সময় স্বাধীনতার দাবিতে আয়োজিত বাংলাদেশ চারু ও কারুশিল্পীদের মিছিলের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মুর্তজা বশীর।

১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসাবে অবসর নেন মুর্তজা বশীর।

Advertisements

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর গল্প, উপন্যাস ও কবিতাও লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম হচ্ছে- গল্পগ্রন্থ ‘কাঁচের পাখির গান’, উপন্যাস ‘আলট্রামেরিন, কবিতাগ্রন্থ- ‘এসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’ এবং ‘এসো ফিরে অনসূয়া’ ও নির্বাচিত রচনা ‘মুর্তজা বশীর : মূর্ত ও বিমূর্ত’ ।
১৯৮০’র দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মিউজিয়ামে সংগ্রহ কমিটির দায়িত্বপালন করতে যেয়ে প্রাচীন মুদ্রা সংগ্রহ ও গবেষণায় আকৃষ্ট হন মুর্তজা বশীর। ১৯৮৯ সালে ‘জার্নাল অর ল্যুমেসমেটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ নামে বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত জার্নালে তাঁর সুলতানী আমলের মুদ্রা সংক্রান্ত ৬টি প্রবন্ধ ছাপা হয়। হাবশী সুলতানদের বিষয়ে তাঁর লেখা ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয়েছে।

মুর্তজা বশীর বিভিন্ন চারুকলা প্রদর্শনীতে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ্ বাংলাদেশ ও বাংলা একাডেমীর আজীবন সদস্য ছিলেন।

কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মুর্তজা বশীর পেয়েছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার-পদক এবং সম্মাননা। যার মধ্যে- জাতীয় পুরস্কার (Prix National), চিত্রশিল্প উৎসব, ক্যাগনেস-সুর মের, ফ্রান্স (১৯৭৩), ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ প্রচ্ছদ নকশা, জাতীয় বই কেন্দ্র, ঢাকা (১৯৭৬), ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৮৯ সালে বাংলা ১৪০০ বছর উপলক্ষে চট্টগ্রাম আইনজীবী সহকারী সমিতি কর্তৃক সম্মাননা, ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম ইয়ুথ কয়ার প্রদত্ত একুশে মেলা পদক, ২০০৩ সালে সুলতান স্বর্ণপদক, ২০০৭ সালে কবি চন্দ্রাবতী স্বর্ণপদক, বার্জার ইয়াং পেইন্টার্স এ্যাওয়ার্ড-এ আজীবন সম্মাননা, হামিদুর রহমান পুরস্কার, ব্যক্তিজীবনে চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে আমিনা বেগম-এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর দুই কন্যা যুঁই ও যূথি এবং একমাত্র পুত্র যামী।

মর্তুজা বশীর শুধু দেশের একজন অন্যতম চিত্রশিল্পীই নন তিনি একাধারে ভাষাসৈনিক, শিল্পকলার শিক্ষক, কবি, উপন্যাসিক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, শিল্পনির্দেশক, গবেষক ও মুদ্রাতত্ত্ব বিশারদ ছিলেন। অবিরত শিল্পচর্চা, সৃজনশীল গবেষণা, উদ্ভাবন, অনুভূতির বিশ্লেষণ আর রাজনীতি সচেতন থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্পৃক্ততায় শিল্পভাষার ক্ষেত্রে নিজস্বতা প্রকাশে তিনি ছিলেন সদা উদগ্রীব ও প্রাণবন্ত এক গুণীজন । বাংলাদেশের কৃস্টি, সংস্কৃতি, মানুষের জীবনবোধ ও আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে তিনি জীবন্ত রেখেছিলেন তাঁর শিল্পকর্মের মাধ্যমে । আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর অনন্তলোকে ভালো থাকুন এই আমাদের প্রার্থণা।

সাবস্ক্রাইব
Notify of
guest
0 মন্তব্য
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন