কক্সবাজারের টেকনাফে টানা কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এতে পাহাড় ধসের ঝুঁকি বাড়লেও এখনো অনেক মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানেই রয়ে গেছেন। টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় অন্তত অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়াসহ আশপাশের বেশ কিছু এলাকায় দেখা গেছে, পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করছে শত শত পরিবার। অব্যাহত বর্ষণের ফলে এসব এলাকায় ধসের আশঙ্কা তৈরি হলেও সেখানকার মানুষজন নিরাপদ আশ্রয়ে না যাওয়ায়, বিপাকে পড়েছে স্থানীয় প্রশাসন। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে বারবার সর্তক করা হলেও অনেকে বাড়ি ছাড়ছেন না।
টেকনাফ পৌর এলাকার কলেজপাড়া, শীলবনিয়া পাড়া, ডেইলপাড়া, জালিয়াপাড়া, অলিয়াবাদ, খানকারডেইল, চৌধুরীপাড়া, কেকে পাড়া, সাবরাং, নয়াপাড়া ও শাহপরীর দ্বীপের অধিকাংশ বসতবাড়ি পানির নিচে চলে গেছে। টেকনাফ সরকারি কলেজ, আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাঙ্গণও প্লাবিত হয়েছে। হ্নীলা ইউনিয়নের রঙিখালী, ওয়াব্রাং, মৌলভীবাজার, ফুলের ডেল এবং হোয়াইক্যং ইউনিয়নের খারাং খালী, লম্বা বিল, কানজর পাড়া, মিনা বাজার, ওয়াব্রাং সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলোতেও পানি ঢুকে পড়েছে।
বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন মোস্তফা খাতুন নামের এক নারী, যার কোলে রয়েছে চার মাস বয়সী শিশু রুহি আক্তার। তিনি বলেন, ‘রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে না আসলে বাঁচতাম কিনা জানি না। সকালে শুনি পাহাড় ধসে আমার ঘর ভেঙে গেছে। আমার মতো আরও অনেকের বাড়ির পাশে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি আরও বলেন,‘বর্ষাকালে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসতে হয়, রোদ উঠলে চলে যায়। এখানে আমাদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন বেলা খাবার দিয়েছে। তবে আমাদের চাওয়া হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের নিরাপদ জায়গায় পূর্নবাসন করা হোক।’
আরেক আশ্রয়প্রার্থী খুরশিদা বেগম বলেন, ‘আমাদের পরিবারের ছয়জন সদস্য। গতকাল আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। কিন্তু এখান থেকে কোথায় ফিরব, কিছুই জানি না।’ একইভাবে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত রহমত উল্লাহ বলেন, ‘চলে যেতে মন চায়, কিন্তু ছাগল-হাঁস-মুরগিগুলোর কী হবে? ওদের রেখেই কি যাব? যেভাবে বৃষ্টি হচ্ছে, তাতে আর টিকতে পারছি না।’
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আমিন বলেন, ‘প্রতিবছর এমন ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হয়। যদি সরকার নিরাপদ জায়গায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করত, তাহলে কেউ পাহাড়ে থাকত না।’
অন্যদিকে, সাবরাং উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘এভাবে একটানা বৃষ্টি টেকনাফে খুব কম দেখা গেছে। বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। খাওয়া-দাওয়া তো দূরের কথা, ঘুমানো বা প্রাকৃতিক কাজ করতেও চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে জনজীবন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।’
টেকনাফ সিপিপি লিডার কুলসুমা আক্তার বলেন,‘কয়েকদিন ধরে আমাদের সিপিপির টিম পাহাড়ে অবস্থানরত বসবাসকারীদের নিরাপদে সরে আসতে বলছে। এখন পর্যন্ত দেড়শ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছে। অনেক মানুষ সেখানে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন।’
স্থানীয় বাসিন্দা করিম উল্লাহ বলেন,‘মূলত বন বিভাগকে ম্যানেজ করে রোহিঙ্গাসহ অনেকে পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ ঠিলায় ঘরবাড়ি করেছে। যেগুলো বর্ষা আসলে ধসে পরার শঙ্কা রয়েছে। যেসব মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছে। তাদের সরিয়ে না নিলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে।’
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন জানান, সেন্টমার্টিনসহ টেকনাফের জন্য ১৫ টন বরাদ্দা দ্রুত ক্ষতিগ্রস্তদের বিতরণ করা হবে। এছাড়া পাহাড়ে ঝুঁকিতে থাকা বসবাসকারীদের নিরাপদে চলে আসতে মাইকিং করা হচ্ছে। আর যারা আশ্রয়কেন্দ্র চলে এসেছে তাদের তিন বেলা খাবার দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি পানিবন্দি মানুষদের ত্রাণ পৌছে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে।
২০১০ সালের ১৪ জুন সকাল থেকে রাতভর টানা বর্ষণে টেকনাফ উপজেলায় পাহাড় ধসে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়। এছাড়া উখিয়ায় ২০১০ ও ১২ সালের টানা বর্ষণে পাহাড় ১৫ জন নিহত হয়েছিল।