English

28 C
Dhaka
শুক্রবার, মে ৩, ২০২৪
- Advertisement -

‘সিদ্ধান্তহীনতায়’ ধসের ঝুঁকিতে বায়েজিদ লিংকরোডের ১৬ পাহাড়

- Advertisements -

বর্ষা মৌসুমে চরম ঝুঁকিতে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংকরোডে থাকা ১৬ পাহাড়। ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটা পাহাড়গুলোর মাটি বৃষ্টিতে অল্প অল্প করে ধসে পড়ছে। গত বছর এপ্রিলে ধসের কারণে একপাশের সড়ক বন্ধ ছিল প্রায় চার মাস। এরপরও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি দায়িত্বরত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

Advertisements

জানা যায়, কখনো পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, কখনো পরিবেশ অধিদপ্তর, আবার কখনো পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগর অফিসে চিঠি চালাচালি করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। প্রায় আড়াই বছর ধরে এ চিঠি চালাচালি চললেও ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটা পাহাড়গুলো নিয়ে কোনো সমাধান হচ্ছে না। বরং এগুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।

সিডিএ’র পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পাহাড়গুলোকে নতুন করে ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। ধসের ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়গুলো নিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে সবশেষ বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে ১৩ সদস্যের কমিটি।

জানা যায়, চট্টগ্রাম শহরের যানজট নিরসন করতে মূল শহরের প্রবেশদ্বারের সঙ্গে সংযুক্ত করে বাইপাস সড়ক করার উদ্যোগ নেয় সিডিএ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ওই সময়ের ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার প্রকল্পটি শেষ হয় ৩২০ কোটি টাকায়।

Advertisements

চট্টগ্রাম বাইপাস সড়ক নামে ওই প্রকল্পের জন্য ৯২০ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১৯ সালের ১২ মে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকল্পটির জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়। প্রকল্পের আওতায় একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজসহ ছয়টি ব্রিজ এবং কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের ৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে কাটা হয় ১৬টি পাহাড়।

কিন্তু বেপরোয়াভাবে পাহাড় কাটার অভিযোগ পেয়ে ২০২০ সালের শুরুতে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিদর্শনে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানতে পারেন, একেবারে নতুন রাস্তাটি নির্মাণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন নেওয়া হলেও সিডিএ ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট পাহাড় কেটেছে। এ নিয়ে সিডিএকে নোটিশ দিয়ে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি শুনানিতে তলব করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

শুনানিতে অনুমোদনের চেয়ে প্রায় সাত লাখ ঘনফুট বেশি পাহাড় কেটে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, পাহাড়ের উপরিভাগের মাটি ও ভূমির বাইন্ডিং ক্যাপাসিটি নষ্টসহ পরিবেশ-প্রতিবেশের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়। শুনানি শেষে সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা করেন অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) রুবিনা ফেরদৌসী।

এরপর ৬ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নকশা না মেনে পাহাড় কাটার অভিযোগ তোলেন সিডিএ’র বিরুদ্ধে। পরে জরিমানার বিষয়টি নিয়ে বন পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে আপিল করে সিডিএ।

বিষয়টি এখনো অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। একইভাবে পরের ১৩ ফেব্রুয়ারি আরেক শুনানিতে প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান স্পেকট্রা ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেডকেও ৫ কোটি ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

জরিমানার দুই মামলা আপিল শুনানিতে এখনো নিষ্পত্তি হয়নি বলে জানা যায়।

অন্যদিকে ঝুঁকিপূর্ণ খাঁড়া পাহাড়গুলো নতুন করে কাটার জন্য ২০২০ সালের ২৩ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরে ফের আবেদন করে তিন লাখ ৩২ হাজার ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি চায় সিডিএ। প্রকল্পে আগে কাটা ১৬টি পাহাড় ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার জন্য সিডিএ প্রস্তাবনা দিলেও তা নাকচ করে দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের অনুমোদন চাওয়া হলেও ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাহাড় কাটার অনুমতি মেলেনি। এরপর ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো কাটা ও সংরক্ষণ কীভাবে করা হবে, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মতামতসহ প্রতিবেদন চায় পরিবেশ অধিদপ্তর। এরপর সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রকল্প পরিচালক ও চুয়েটের দুই শিক্ষকের সমন্বয়ে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা বুয়েটের দুই শিক্ষক ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ করেছেন।

পরবর্তীসময়ে পরামর্শকসহ পুরো কাজের জন্য সিডিএকে ১০ কোটি টাকার প্রস্তাব দেয় চুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম। তবে চুয়েটের ওই বিশেষজ্ঞ টিমের এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় নতুন করে বিএসআরএম-মেগাফেরি জেভি নামে আরেকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় সিডিএ।

সম্প্রতি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটি তাদের প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ ১৬ পাহাড় ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার পরামর্শ দেয়। এরপর পরামর্শকের প্রতিবেদনের বিষয়ে অবগত করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় সিডিএ।

সম্প্রতি সরেজমিনে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টিতে পাহাড়গুলোর অনেক স্থান ধসে পড়ছে। ধসের ঝুঁকির মধ্যেও সড়কটি দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করছে শত শত যানবাহন। ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো দখলে রাখতে-নামে বেনামে অসংখ্য সাইনবোর্ডও তুলেছেন প্রভাবশালীরা। কয়েকটি পাহাড়ের ঢালুতে দোকান বসিয়ে দখল পাকাপোক্ত করেছেন অনেকে।

এ বিষয়ে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, ২০২০ সাল থেকে প্রায় আড়াই বছর ধরে ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটা পাহাড়গুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এগুলো কেটে ঝুঁকিমুক্ত করতে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে অনুমতি চাওয়া হয়েছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের অনীহার কারণে এখন পাহাড়গুলোকে ঝুঁকিমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী আমরা চুয়েট (চট্টগ্রাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে একটি বিশেষজ্ঞ টিম নিয়োগ করেছিলাম। তারা আর্থিক যে প্রস্তাবনা দিয়েছে সেটিতে আমরা সন্তুষ্ট হইনি। পরবর্তীসময়ে বিএসআরএম-মেগাফেরি জেভিকে পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছিলাম। তারা এরই মধ্যে প্রতিবেদন দিয়েছে।

এ ব্যাপারে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড প্রকল্পের পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার বলেন, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের ১৬ পাহাড় মানসম্মতভাবে কাটার বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম-মেগাফেরি জেভি তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তারা ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাহাড়গুলো কাটা যাবে বলে পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু এর আগে আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরে পাহাড়গুলো ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার অনুমতি চেয়েছিলাম। এখন ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটতে হলে কীভাবে কাটবো, পরবর্তী ব্যবস্থাপনা বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি চাওয়া হবে।

এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের পরিচালক (উপ-সচিব) হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের ১৬টি পাহাড় কাটার বিষয়ে সিডিএ কনসালট্যান্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনসহ একটি আবেদন করেছে মন্ত্রণালয়ে। ওই প্রতিবেদনে ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাহাড়গুলো কাটার বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয় বলে জেনেছি। তবে আমরা প্রত্যেকটি পাহাড় কীভাবে কাটবেন, পাহাড়গুলোর পরবর্তী ব্যবস্থাপনা, কাটা মাটির ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সিডিএ’র কাছে প্রতিবেদন চেয়েছি। তারপরেও গত ২১ জুন পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় বিভাগীয় কমিশনার পাহাড়গুলোর কাটার সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে ১৩ সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করেছেন। এ কমিটির প্রতিবেদনের পর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

সাবস্ক্রাইব
Notify of
guest
0 মন্তব্য
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন