বাল্যবিবাহ বাংলাদেশে এখনো একটি অভিশাপ হিসেবেই রয়ে গেছে। কিশোরীদের জীবনে সেই অভিশাপের বোঝা আরো প্রবল হয়েছে কভিড-১৯ মহামারির সময়। ‘অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস ভালনারেবিলিটিস অ্যান্ড ট্রানজিশন ইন দ্য কনটেক্সট অব কভিড-১৯’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ কিশোরী এ সময় বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। ব্র্যাক পরিচালিত গবেষণায় দুই হাজার ৭৫৮ পরিবারপ্রধানের সাক্ষাত্কার নেওয়া হয়েছে।
তাঁদের ৫০ শতাংশই স্বীকার করেছে, মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কভিড-১৯ ভূমিকা রেখেছে। গবেষণায় সাক্ষাত্কার নেওয়া তিন হাজার ১৩৯ জন কিশোর-কিশোরীর মধ্যে ৩৫ শতাংশ জানিয়েছে, করোনার কারণে তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। আর খরচ চালাতে না পেরে লেখাপড়া ছেড়েছে বলে জানিয়েছে ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী।
বাল্যবিবাহ রোধে সরকার নানা রকম কর্মসূচি নিয়েছে। শাস্তির ব্যবস্থা রেখে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে পড়ানো বা ভুল তথ্য দিয়ে কাবিন রেজিস্ট্রির জন্য অনেক কাজি বা অভিভাবকের শাস্তিও হয়েছে। তবু বাল্যবিবাহ এখনো সমাজে একটি কলঙ্ক হিসেবে বিরাজ করছে। ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে গবেষণাটি পরিচালিত হয়। গবেষণার আওতায় ছিল কুমিল্লা, নড়াইল ও গাইবান্ধা জেলার ২৬টি উপজেলার ২৬০টি গ্রাম (প্রতি উপজেলায় ১০টি করে)। দেশব্যাপী আরো ব্যাপক গবেষণা হলে হয়তো বাল্যবিবাহের হার আরো বেশি হতে পারত। কিন্তু যে হার উঠে এসেছে, তা কি কম উদ্বেগজনক? বাল্যবিবাহ রোধে এত আয়োজন, এত সচেতনতামূলক পদক্ষেপ সত্ত্বেও শুধু করোনা মহামারির কারণে এত বেশিসংখ্যক কিশোরী বাল্যবিবাহের শিকার হবে, তা মেনে নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাল্যবিবাহ এবং স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পেছনে দারিদ্র্যের চেয়েও বড় ভূমিকা পালন করেছে নিরাপত্তার অভাব ও পারিবারিক সম্মান হারানোর ঝুঁকি। অতীতেও বাল্যবিবাহের জন্য অনেক অভিভাবক এই দুটি ঝুঁকির কথা বলেছেন। আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি গভীরভাবে ভাবতে হবে এবং সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে দেশ কখনো বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে না। অর্থনৈতিক সমস্যা যেন কিশোরীদের শিক্ষাজীবনকে ধ্বংস করে না দেয় তার উপায় খুঁজতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যালয়ের পরিবেশ, শিক্ষার মান এবং কিশোরীদের নিরাপত্তা বাড়াতে হবে।
করোনা সংক্রমণ কমলেও এখনো আমরা পুরোপুরি ঝুঁকিমুক্ত নই। তাই করোনা যাতে কিশোরীদের জীবনের ওপর আবারও এমন ক্ষতিকর প্রভাব না ফেলতে পারে সে ব্যাপারে আমাদের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে সমাজকে মুক্ত করতে শিক্ষক, জনপ্রতিনিধিসহ সমাজের নেতৃস্থানীয় লোকদের এগিয়ে আসতে হবে।