পৃথিবীতে খুব কম শহর আছে যার চারপাশে চারটি নদী রয়েছে। ঢাকা সেদিক থেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। কিন্তু অব্যাহত অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে সেই সৌভাগ্য আজ দুর্ভাগ্যের রূপ নিয়েছে। নদীর পানি এতটাই নষ্ট ও দুর্গন্ধযুক্ত যে সেখানে ভ্রমণ তো দূরের কথা, নদীর পার দিয়ে হাঁটাও কষ্টসাধ্য। ক্রমাগত দখল, দূষণ ও ভরাটের কারণে সব নদী মৃতপ্রায়। শুষ্ক মৌসুমে পানি থাকে না বললেই চলে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তুরাগ নদ ও এর সঙ্গে সংযুক্ত খাল-বিলে শত শত কারখানার অশোধিত তরল বর্জ্য নিয়মিতভাবে পড়ছে। কুচকুচে কালো পানি ব্যবহারের অনুপযোগী। টঙ্গী ও গাজীপুরের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের চিত্র একই। অনেক কারখানায় ইটিপি থাকলেও খরচ বাঁচাতে সেগুলো বন্ধ রাখা হয়। শুধু তরল বর্জ্য নয়, গৃহস্থালি বর্জ্যসহ কঠিন বর্জ্যও ব্যাপক হারে ফেলা হচ্ছে নদীতে। ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই তুরাগ ও বালু নদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।রাজধানী ঢাকা মহানগরীর অস্তিত্ব অনেকাংশেই নির্ভর করে চারপাশের নদীগুলোর অস্তিত্বের ওপর। রাজধানীর পানীয় জলের উৎসগুলো ক্রমেই ধ্বংস হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী নদীগুলোর পানিতে লেড, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য অবমুক্ত হচ্ছে। এগুলো ভূগর্ভে প্রবেশ করে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নদীর নাব্যতা না থাকলে ঢাকার পানি নিষ্কাশনও বাধাগ্রস্ত হবে। জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নেবে। প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ রিভার ফাউন্ডেশন শুধু তুরাগ নদের টঙ্গী থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৪২ কিলোমিটার অংশে ২২৪টি এবং চিলাইয়ে পানিদূষণের ৪৫টি উৎস চিহ্নিত করেছে। তাদের পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে ভয়াবহ দূষণ হচ্ছে—পাগাড়, আরিচপুর, মাছিমপুর, টঙ্গী বাজার, কামারপাড়া, রুস্তমপুর, ইছরকান্দি, কাশিমপুর, কড্ডা, মির্জাপুর, বোয়ালী, মকশ বিল, কালিয়াকৈর বাজার, দেশীপাড়া ও জয়দেবপুর এলাকায়। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৩৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা জানায়, কারখানার তরল বর্জ্যের কারণে তুরাগ খালের পানি আলকাতরার মতো ভারী হয়ে গেছে। এই পানি লাগলে শরীর চুলকায়, ঘা হয়ে যায়।
নদী রক্ষার দাবিতে আশির দশক থেকে নাগরিকরা আন্দোলন করছে। উচ্চ আদালত বারবার নদী রক্ষায় নির্দেশনা দিয়েছেন। ২০০৯ সালে দেওয়া ১২ দফা নির্দেশনার মধ্যে ছিল ক্যাডেস্ট্রাল সার্ভে বা সিএস মানচিত্র অনুযায়ী স্থায়ীভাবে নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ, নদীর পার দিয়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, অনেক বৃক্ষরোপণ, নদীর মধ্যে থাকা সব ধরনের স্থাপনা উচ্ছেদ করা ইত্যাদি। কিন্তু সেই কাজগুলো এখন পর্যন্ত যথাযথভাবে সম্পাদন করা হয়নি। দূষণ রোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখনো নদীর ওপর চলছে নানা ধরনের আগ্রাসী আয়োজন। পরিবেশ অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা চরম উদাসীনতা দেখাচ্ছে। আমরা এই আত্মঘাতী উদাসীনতার অবসান চাই।