এ কে আজাদ: রোজী। অভিনেত্রী। সুঅভিনেত্রী। মিষ্টি হাসির দৃষ্টি কাড়া সুন্দরী অভিনেত্রী রোজী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালী সময়ের, সীমাহীন জনপ্রিয় অভিনেত্রী । তাঁর ভুবন ভুলানো, মুক্তোঝরা হাসিতে বিমোহিত হয়েছে লাখো-কোটি সিনেমাদর্শক। রোমান্টিক নায়িকা থেকে চরিত্রাভিনেত্রী, চরিত্রের প্রয়োজনে অভিনয় প্রতিভার সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন- সবখানে। একসময় পারিবারিক-সামাজিক ছবির অসম্ভব প্রভাবশালী অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। চরিত্রাভিনেত্রী হলেও তাঁর চাহিদা ছিল নায়িকাদের চেয়েও বেশী। অসংখ্য বাণিজ্যসফল হিট-সুপারহিট চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। অভিনয় করেছেন বহু জনপ্রিয় ও কালজয়ী চলচ্চিত্রে।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনাও করেছেন।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের, মিষ্টি হাসির দৃষ্টিকাড়া সুন্দরী অভিনেত্রী রোজী’র মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি আজ থেকে ১৭ বছর আগে, ২০০৭ সালের ৯ মার্চ, ৬২ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। প্রয়াত এই গুণী অভিনয়শিল্পীর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই । তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
জনপ্রিয় অভিনেত্রী রোজী (শামীমা আখতার রোজী/রোজী সামাদ নামেও অধিক পরিচিত ছিলেন/পরবর্তিতে রোজী আফসারী) ১৯৪৫ সালের ২৩ এপ্রিল, লক্ষ্মীপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ (সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং চলচ্চিত্র সংগঠক) এবং মাতার নাম আখতারী বেগম (চল্লিশ দশকের জনপ্রিয় নাট্য অভিনেত্রী)। দুই ভাই এবং চার বোন-এর মধ্যে, রোজী ছিলেন সবার বড়।
তাঁর লেখাপড়া শুরু হয় ‘উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে’ । জুনিয়র ক্যামব্রিজ করেছিলেন ঢাকার ‘ভিকারুননিসা নুন স্কুল’ থেকে।
১৯৬৩ সালে তিনি প্রথম নায়িকা হিসেবে অভিনয় করার সুযোগ পান ‘এইতো জীবন’ চলচ্চিত্রে। জিল্লুর রহিম পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৪ সালে। এই ছবিতে রোজী’র বিপরিতে নায়ক ছিলেন শওকত আকবর।
তিনি প্রায় বিশ-এর অধিক ছবিতে নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন ।
পরবর্তিতে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে (মা-বাভী-বড় বোন) ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং দর্শক নন্দিত হন। একের পর এক মুক্তি পেতে থাকে তাঁর জনপ্রিয় ও সুপারহিট সব চলচ্চিত্র। রোজী অভিনীত অসংখ্য ছবি’র মধ্যে- সংগম, তানহা, বন্ধন, পুনম কি রাত, একালের রূপকথা, ভাইয়া, উলঝন, সোয়ে নদীয়া জাগে পানি, চাওয়া পাওয়া, রাখাল বন্ধু, চেনা অচেনা, এতটুকু আশা, চোরাবালি, বেদের মেয়ে, আলোর পিপাসা, ইস ধরতি পর, জোয়ার ভাটা, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, প্রতিকার, ক খ গ ঘ ঙ, জীবন থেকে নেয়া, কাচঁ কাটা হীরে, অধিকার, ঘূর্ণিঝড়, দ্বীপ নিভে নাই, স্মৃতিটুকু থাক, জলছবি, সুখ দুঃখ, দেবর, সমাধান, দাসী, নিজেরে হারায়ে খুঁজি, কাঁচের স্বর্গ, জীবন সঙ্গীত, রংবাজ, পায়ে চলার পথ, তিতাস একটি নদীর নাম, চোখের জলে, আলোর মিছিল, আঁধারে আলো, ঈসা খাঁ, দুই রাজকুমার, সূর্যগ্রহন, লাঠিয়াল, দম মারো দম, ফকীর মজনু শাহ, গোলাপী এখন ট্রেনে, অশিক্ষিত, সাধারণ মেয়ে, বড় বৌ, মানুষের মন, বন্ধু, বাহরাম বাদশা, জীবন সঙ্গীত, স্বীকৃতি, পরিচয়, প্রতিনিধি, দি রেইন, দাবী, বেলা শেষের গান, সূর্যসংগ্রাম, স্বামী, মিন্টু আমার নাম, শ্রীমতী ৪২০, ঘরজামাই, ছোট মা, নাগ নাগিনী, ইশারা, নাগরদোলা, রূপালী সৈকতে, মোকাবোলা, হুর এ আরব, কলমীলতা, সুখের সংসার, সওদাগর, বিনি সুতার মালা, স্বামী, ওমর শরীফ, আনারকলি, সেলিম জাভেদ, আল হেলাল, টক্কর, মেঘ বিজলী বাদল, সাত রাজার ধন, ইজ্জত, প্রতিহিংসা, চেনামুখ, চ্যালেঞ্জ, নাজমা, গাদ্দার, পদ্মাবতী, জোশ, মহেশখালীর বাঁকে, নরম গরম, সালতানাত, রাজদন্ড, ঘরে বাইরে, গীত, মায়ের দাবী, গোলমাল, শিরি ফরহাদ, আশা নিরাশা, দ্বীন দুনিয়া, জালিম, মহল, সকাল সন্ধ্যা, রাজদণ্ড, কোরবানি, বেরহম, আঘাত, শশীপুন্নু, ঝড় তুফান, জুলি, ক্ষতিপূরণ, ক্ষমা, রাস্তার রাজা, দেশ দুশমন, দরবার-এ খাজা, মালামাল, ঝড় তুফান, ভাঙচুর, এই ঘর এই সংসার, হীরা চুন্নি পান্না, শাস্তি, পরম প্রিয়, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য ।
রোজী বেতার এবং টেলিভিশন নাটকেও অভিনয় করেছেন এবং জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। স্বাধীনতার আগে জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিক নাটক ‘সংশপ্তক’-এ ‘হুরমতী’র ভুমিকায় অসাধরণ অভিনয় করে চিরস্বরণীয় হয়ে আছেন।
অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করেছেন। তাঁর প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘রোজী ফিল্মস’। তিনি ‘আশা নিরাশা’ নামে একটি চলচ্চিত্রও পরিচালনা করেছেন।
প্রতিভাবান এই গুণি অভিনয়শিল্পী, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রথম (ছবি-লাঠিয়াল- ১৯৭৫) আসরেই শ্রেষ্ঠ পার্শ্বঅভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন।
এছাড়া পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘নিগার অ্যাওয়ার্ড’সহ দেশি-বিদেশি বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এরমধ্যে আছে- ৭২, ৭৩, ৭৪, ৭৫ সালের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জিয়া স্বর্ণপদক, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সমিতি পুরস্কার, বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, পূর্বাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার, এফডিসির রজত জয়ন্তী পুরস্কার, কালচারাল রিপোর্টাস অ্যাওয়ার্ড, স্বদেশ সাংস্কৃতিক স্বর্নপদক, অনির্বাণ সংসদ স্বাধীনতা পদক, মহিলা চিত্রপরিচালক হিসেবে সিডাব পুরস্কার, প্রভৃতি।
ব্যক্তিজীবনে তিনি দুইবার বিবাহ করেন। প্রথমে বিবাহ হয় খ্যাতিমান চলচ্চিত্রগ্রাহক ও পরিচালক আবদুস সামাদের সাথে । এ সংসারে তাঁর একটি কন্যাসন্তান আছে, নাম কবিতা সামাদ। পরবর্তীতে চিত্রপরিচালক মালেক আফসারীকে বিয়ে করেন তিনি।
মিষ্টি হাসির দৃষ্টি কাড়া সুন্দরী অভিনেত্রী রোজী। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালী সময়ের, সীমাহীন জনপ্রিয় ও দর্শক নন্দিত অভিনেত্রী রোজী। রোমান্টিক নায়িকা থেকে চরিত্রাভিনেত্রী, চরিত্রের প্রয়োজনে, অভিনয় প্রতিভার সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন- সবখানে। অসংখ্য ব্যবসাসফল, হিট-সুপারহিট, জনপ্রিয়-কালজয়ী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন রোজী। একসময় পারিবারিক-সামাজিক ছবির প্রভাবশালী অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। চরিত্রাভিনেত্রী হলেও তাঁর চাহিদা ছিল নায়িকাদের চেয়েও বেশী। তখন তাঁর সাথে জুটি হিসেবে ছিলেন, আরেক প্রখ্যাত অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। তাঁরা দুজন ছবিতে থাকা মানে, সেই ছবি দর্শক চাহিদায় এক নাম্বারে, ছবি হিট-সুপারহিট হওয়ার সমূহ-সম্ভাবনা।
অভিনেত্রী রোজী যখন যে চরিত্রই করেছেন, মনে হয়েছে এটাই তাঁর জন্য আদর্শ চরিত্র। অভিনয় দক্ষতার এতটা দাপট দেখিয়েছেন যে, নিজেকে নিয়ে গেছেন জনপ্রিয়তার অনন্য উচ্চতায়। কিংবদন্তীতুল্য এই অভিনেত্রী, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের ইতিহাসে, চির-অমলিন হয়ে থাকবেন।