English

28 C
Dhaka
মঙ্গলবার, মে ৬, ২০২৫
- Advertisement -

এখনোও বেদের মেয়ে জোসনা কেন সর্বোচ্চ ব্যবসা-সফল ছবি

- Advertisements -

নাসিম রুমি: ‘বেদের মেয়ে জোসনা’-বাংলাদেশের বক্স অফিসে সর্বোচ্চ রেটিংপ্রাপ্ত সিনেমা, যেটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল তখন প্রায় ২০ লাখ টাকা, যা বর্তমান সময়ের হিসাবে প্রায় দেড় কোটি টাকা। বিপরীতে আয় হয়েছিল প্রায় ২৫ কোটি (তৎকালীন), আর বর্তমান হিসাবে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। ছবিটির এ আয়ের রেকর্ড এযাবৎ এ দেশের অন্য কোনো ছবির পক্ষে ভাঙা সম্ভব হয়নি।

ঢালিউডের বক্স অফিসের নিরিখে এখন অবধি সুপারহিট সিনেমা হচ্ছে তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত বেদের মেয়ে জোসনা। যার ফলে আয়ের নিরিখে সবার ওপরে আছেন অঞ্জু ঘোষ ও ইলিয়াস কাঞ্চন। বক্স অফিস অনুযায়ী- সর্বোচ্চ রেটিংপ্রাপ্ত সিনেমা হচ্ছে বেদের মেয়ে জোসনা। বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত বেদের মেয়ে জোসনা চলচ্চিত্রটি একক অনন্য মাইলফলক।

১৯৮৯ সালের ৯ জুন ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। মুক্তির পরপরই দর্শকমহলে তুমুল জনপ্রিয় হয় এটি। এ সিনেমাতে নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেন অঞ্জু ঘোষ এবং তাঁর বিপরীতে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন ইলিয়াস কাঞ্চন। ছবিটির প্রযোজক ছিলেন আব্বাস উল্লাহ শিকদার ও মতিউর রহমান পানু।এ সিনেমাটি এতই জনপ্রিয়তা পায় যে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তোজাম্মেল হক বকুল সিনেমাটি পুনর্র্নির্মাণ করেন। শুধু সিনেমা নয়, এ সিনেমার প্রতিটি গানই দর্শকদের মন ছুঁয়ে গেছে। এর সংগীত পরিচালনা করেন আবু তাহের। এতে ১১টি গান রয়েছে।

এ ১১টি গানের মধ্যে ১০টির গীত রচনা করেছেন ছবির পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল।সিনেমাটির গান এত জনপ্রিয় হয়েছিল যে, এ সিনেমার গানের অডিও ক্যাসেট মুক্তির পর এক মাসের মধ্য ১ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। ছবির শিরোনাম গানটি হলো- ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’। এ গানটি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। ছবির দৈর্ঘ্য ছিল ২ ঘণ্টা ১০ মিনিট। এ চলচ্চিত্রটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের তালিকার মধ্যে একটি। প্রথমে বেদের মেয়ে জোসনা চলচ্চিত্রটির স্বত্বাধিকারী ছিল আনন্দমেলা চলচ্চিত্র। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বঙ্গ বিডি চলচ্চিত্রটির পুনর্র্নির্মাণের জন্য আনন্দমেলা চলচ্চিত্রের কাছ থেকে স্বত্ব কিনে নেয়। এ ছবিটি যে এত সাফল্য পাবে তা প্রযোজক-পরিচালকদের কেউ ভাবেননি।

বেদের মেয়ে জোসনার আধিপত্যে অন্য প্রযোজক-পরিচালকরা বসে পড়েছিলেন। কারণ তখন নতুন কোনো ছবি মুক্তি দেওয়া যাচ্ছিল না। গাঁয়ের বধূরা ঘর উজাড় করে ছবিটি দেখতে সিনেমা হলে ভিড় জমিয়েছিলেন। গাঁয়ের মেয়েদের এ আগ্রহ খবর হয়ে গিয়েছিল শহরে, পরে শহরের হলগুলোতেও ভিড় বেড়েছিল। দেশে তখন মোট সিনেমা হলের সংখ্যা ১ হাজার ২০০। অথচ প্রথমে বেদের মেয়ে জোসনা দেখাতে রাজি হয়েছিল মাত্র ২০টি হল। মাস দুই পর পরিস্থিতি এতটাই উল্টে গিয়েছিল যে, ছবিটির পরিবেশকরা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের হলগুলোর কাছে দেড় লাখ টাকা অগ্রিম চেয়েছিলেন।

আরও দাবি ছিল, যদি ছবিটি বড় ব্যবসা করে, তাহলে লভ্যাংশও দিতে হবে। ‘যশোর, খুলনা অঞ্চল থেকেই খবর আসছিল বেশি; লাইন ধরে লোকে হলে ঢুকছে, হাপুস নয়নে কাঁদছে, খুশি হয়ে বের হয়ে আসছে। একই লোক পরদিন আবার যাচ্ছে, আবার কাঁদছে, আবার খুশি হয়ে বের হয়ে আসছে। নারীরাই বেশি দেখেছেন ছবিটি। খবর পাওয়া যাচ্ছিল অমুক গ্রামের তমুকের বিবি গাল ফুলিয়ে বাবার বাড়ি চলে গেছেন, কারণ তাকে বেদের মেয়ে জোসনা দেখতে নিয়ে যাচ্ছেন না স্বামী।

তোজাম্মেল হক বকুল বেদের মেয়ে জোসনা চরিত্রটি করার জন্য প্রথমে নায়িকা রোজিনাকেই প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তখন ফোক ছবির নায়িকার কথা উঠলে সবার আগে আসত রোজিনার নাম। কিন্তু ফোক-ফ্যান্টাসির নায়িকা এমন পরিচিতি থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টায় প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন রোজিনা। তখন অঞ্জু ঘোষকে নির্বাচন করা হয়। অন্যদিকে প্রযোজক আব্বাস প্রথমে এ ছবিতে নায়ক চরিত্রে অভিনয়ের জন্য অভিনেতা সাত্তারকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে চুক্তি করিয়েছিলেন। কিন্তু পরিচালক বকুল চাইলেন সে সময়ের সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে নিয়ে কাজ করতে। কিন্তু ইলিয়াস কাঞ্চনের হাতে তখন প্রায় তিন বছরের শিডিউল বুকড। পরে অভিনেতা-প্রযোজক দারাশিকোর অনুরোধে সাত্তারের পরিবর্তে কাঞ্চন এতে অভিনয় করেন। বেদের মেয়ে জোসনার সাফল্য সে কালের অনেক হিসাবনিকাশই বদলে দিয়েছিল।

চিত্রালীর ‘প্রবেশ নিষেধ’ কলামে যেমন লেখা হয়েছিল- ‘বেদের মেয়ে জোসনাতে অঞ্জু ঘোষকে নেওয়া হয়েছে। এক হিসাবে অঞ্জু ফ্লপের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। সেই অঞ্জুই বাজিমাত করল। তাহলে? তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে- শাবানা, ববিতা, রোজিনা, শবনম ছাড়াও ছবি হিট করে। ’ ১৯৮৯ সালের ৪ আগস্ট সংখ্যায় চিত্রালী প্রতিবেদক লিখেছেন- বেদের মেয়ে জোসনার শিল্পীদের আগমনে শুক্রবার সারা দিন খুলনা ছিল উৎসবের নগরী। সারা শহরে একই আলোচনা; অঞ্জু, কাঞ্চন, সাইফুদ্দিন, দিলদারকে দেখতে পারার বর্ণনা আর না পারার আক্ষেপ। হোটেলের আশপাশে ছিল দিনভর লাগাতার ভিড়। ভিড়ের মানুষদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, কেউ কেউ বেদের মেয়ে জোসনা ১৭-১৮ বারও দেখেছেন। বউ স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে, কানের গয়না বিক্রি করে, কেউবা দোকানের মালপত্র বিক্রি করে বেদের মেয়ে জোসনা দেখেছেন একাধিকবার।

সে কালে মুক্তির আগেই ছবির গান বিক্রি করে দেওয়ার চল ছিল। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছিলেন, ‘ছবিটির শুটিংয়ের মধ্যে বুঝতে পারি এটি হিট হবে, কিন্তু সুপারহিট হবে তা ভাবতে পারিনি। ’ এক ব্যবসায়ী অডিও কিনে নিয়েও পরে তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। পরে যিনি কিনেছিলেন তিনি অডিওর লাভেই ১ কোটি টাকা দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। আর আগের ভদ্রলোকের তো প্রায় পাগল অবস্থা। টানা ছয় মাস অসুস্থ ছিলেন। শরীর একটু ভালো হলেই বলতেন, ‘এ আমি কী করেছি’।

বেদের মেয়ে জোসনার আধিপত্যে অন্য প্রযোজক-পরিচালকরা বসে পড়েছিলেন। কারণ নতুন কোনো ছবি মুক্তি দেওয়া যাচ্ছিল না। ‘বেদের মেয়ে জোসনা যে হলে চলছে, সেখান থেকে আর নামছে না। যশোরের মণিহারের মতো প্রেক্ষাগৃহে ১১ সপ্তাহ উত্তীর্ণ হওয়ার পরও বেদের মেয়ে জোসনা চলছে। ওই ছবির বিপরীতে অন্য হলে অন্য ছবিগুলো বেদম মার খাচ্ছে। বেদের মেয়ে জোসনার কারণে যশোরের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে এক মাসে ৮টি নতুন ছবির ব্যবসা ফেঁসে গেছে। ’

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন