English

19 C
Dhaka
বুধবার, ডিসেম্বর ১৭, ২০২৫
- Advertisement -

‘ওরা ১১ জন’ ও নেপথ্যের কারিগর সোহেল রানা

- Advertisements -

নাসিম রুমি: বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়– এটি এক জাতির আত্মপরিচয়ের গল্প। সেই গল্পই প্রথমবারের মতো রুপালি পর্দায় মহাকাব্যিক রূপ পায় ১৯৭২ সালে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’-এ। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই প্রথম সিনেমাটি আজও সময়কে অতিক্রম করে এক অনন্য দলিল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে– ইতিহাস, বীরত্ব আর ত্যাগের জীবন্ত সাক্ষ্য হয়ে। সিনেমাটির পেছনের মানুষদের একজন হলেন ছবিটির প্রযোজক মাসুদ পারভেজ। ওরা ১১ জনের একজন তিনি। ঢাকাই সিনেমার দর্শকদের কাছে যিনি সোহেল রানা নামে পরিচিত।

‘ওরা ১১ জন’ মূলত ১১ জন মুক্তিকামী যুবকের কাহিনি। স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখেছিল। সাদা-কালো পর্দায় ধারণ করা প্রতিটি দৃশ্যে রয়েছে যুদ্ধের নির্মম বাস্তবতা ও মানুষের অদম্য প্রত্যয়। যুদ্ধদৃশ্যকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে তখন ব্যবহার করা হয়েছিল সত্যিকারের গোলাবারুদ– যা আজকের দিনে কল্পনাতীত। সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয়, এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন বাস্তব বীর মুক্তিযোদ্ধারাই। খসরু, মুরাদ, হেলাল, নান্টুর মতো যোদ্ধারা পর্দায় যেন নিজেদের জীবনই তুলে ধরেছিলেন।

সিনেমাটির প্রযোজক সোহেল রানা নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ থেকে ফিরে তাঁর মনে হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের ছোট ছোট ঘটনাগুলো যদি ক্যামেরায় ধরা যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সত্যটা জানতে পারবে। সেই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় ‘ওরা ১১ জন’। নিজের জমানো টাকা আর মা-বাবার কাছ থেকে ধার করা অর্থ নিয়ে শুরু করেছিলেন সিনেমার কাজ।

‘ওরা ১১ জন’ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সোহেল রানা ফিরে যান অর্ধশতাব্দী আগের সেই দুঃসাহসিক সময়ে। তিনি জানান, এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারাই। যুদ্ধের দৃশ্যগুলোতে ব্যবহার করা হয়েছিল সত্যিকারের অস্ত্র ও গোলাবারুদ। এমনকি একপর্যায়ে ভাবা হয়েছিল, রাজাকারদের মৃত্যুদণ্ডের দৃশ্যে সত্যিকারের আটক রাজাকারদের ব্যবহার করা হবে– যদিও শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা হয়।

ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যের শুটিং হয়েছিল কালিয়াকৈর সেতুর কাছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেতুর এক পাশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শুটিংয়ের জন্য বেছে নেওয়া হয় অন্য পাশটি। সেতু ধ্বংসের দৃশ্য দেখাতে বসানো হয় বিস্ফোরক। সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে সোহেল রানা বলেন, বিস্ফোরণের তীব্রতায় নদীর পানি আকাশের দিকে উঠে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে বলে মনে হলেও পরে বোঝা যায়, সেটি আসলে বিস্ফোরণে ছিটকে পড়া নদীর পানি। বিস্ফোরণের পর নদীতে ভেসে ওঠে অসংখ্য মাছ– যেগুলোর কান দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। সেই মাছ রান্না করে খেয়েছিলেন তারা, কেউ কেউ আবার বাড়িতেও নিয়ে গিয়েছিলেন।

ছবিটি পরিচালনার জন্য শুরুতে খ্যাতিমান পরিচালক মুস্তাফিজ বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু চাষী নজরুল ইসলাম যুক্ত হচ্ছেন জানতে পেরে তিনি নিজেই সরে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, সে অনেক দিন ধরে কাজ করছে। সে পারবে। এই ছবির মাধ্যমেই দীর্ঘ ১৪ বছর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করা চাষী নজরুল ইসলামের পরিচালক হিসেবে অভিষেক ঘটে।

অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবস্থা করাটাও ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সোহেল রানা জানান, বন্ধু নূরে আলম সিদ্দিকীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের কাছে। তাঁর নির্দেশে তৎকালীন মেজর শওকতের সহযোগিতায় গোডাউন থেকে রাইফেল, স্টেনগান ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করা হয়। এমনকি পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পোশাকের বাস্তবতা নিশ্চিত করতে একজন মেজরকে ছবির সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল।

প্রযোজক ও পরিচালক– চাষী নজরুল ইসলাম ও মাসুদ পারভেজ ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে চুল কাটতেন, একই রঙের জামা পরতেন। পারিশ্রমিকের প্রশ্নে সোহেল রানা বলেন, চাষীর স্ত্রী জ্যোৎস্নার হাতে প্রতি মাসে কিছু টাকা তুলে দিতেন তিনি, যেন সংসারের চিন্তা না করে চাষী মন দিয়ে সিনেমাটি বানাতে পারেন।

ছবির প্রাথমিক বাজেট আসে পরিবার থেকেই। সোহেল রানার বাবা আবদুল মালেকের পেনশনের টাকা, মা দেলোয়ারা বেগমের সঞ্চয় এবং বোন ফেরদৌস আরা বেগমের কাছ থেকে নেওয়া কিছু অর্থ দিয়েই শুরু হয় যাত্রা।

পরে ইফতেখারুল আলম কিসলুর পরামর্শে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি যুক্ত করা হয় তখনকার জনপ্রিয় অভিনয়শিল্পীদের। রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, খলিলউল্লাহ খান, হাসান ইমাম, রওশন জামিল, মিনারা জামান, এ টি এম শামসুজ্জামানসহ সবাই বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হন। সোহেল রানা বলেন, “তখন কাকে নেব আর কাকে বাদ দেব, সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।”

পরিবেশক স্টারের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরের চুক্তি হয় সাড়ে চার লাখ টাকায়। সেই অর্থেই জয়দেবপুর ও এফডিসিতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় শুটিং।

ছবির সবচেয়ে সংবেদনশীল অংশ ছিল রাজাকার হত্যার দৃশ্য। শুরুতে বাস্তব রাজাকার ব্যবহার করার কথা ভাবা হলেও চিত্রগ্রাহক আবদুস সামাদের আপত্তি ও নৈতিক বিবেচনায় দৃশ্যটি প্রতীকীভাবে ধারণ করা হয়– পানিতে গুলির দৃশ্য, বিচ্ছিন্ন শট আর পড়ে থাকা রক্তাক্ত দেহের মাধ্যমে।

The short URL of the present article is: https://www.nirapadnews.com/sbuf
Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন