এ কে আজাদ: বিপুল ভট্টাচার্য। কণ্ঠশিল্পী। বিশিষ্ট লোকসংগীত শিল্পী হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত ও জনপ্রিয় । দরাজ কন্ঠের অধিকারী এই শিল্পী রেডিও টেলিভিশন ছাড়াও গান গেয়েছেন চলচ্চিত্রেও। এই প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তৎকালীন সময়ে ‘স্বর্ণপদক’ জয় করেছিলেন। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিলো তাঁর অসামান্য অবদান। ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যোগ দেন স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুল ভট্টাচার্যের গাওয়া গান লাখো মুক্তিযোদ্ধার মনে প্রেরণা জুগিয়েছে।শরণার্থী শিবিরের হাজার হাজার মানুষের মনে সাহস সঞ্চার করেছিলেন গানের মাধ্যমে। তিনি ছিলেন ‘মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’র সদস্য।
কণ্ঠশিল্পী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বিপুল ভট্টাচার্যের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০১৩ সালের ৫ জুলাই, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। গুণি কণ্ঠশিল্পী বিপুল ভট্টাচার্যের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
বিপুল ভট্টাচার্য ১৯৫৩ সালের ২৫ জুন, কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নগেশ ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম হেমপ্রভা দেবী। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠ। গোবিন্দপুর হাইস্কুল থেকে এস.এস.সি এবং কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই কলেজে তিনি বি.এ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিলেন। স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি স্কাউটের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।
ছোটবেলা থেকে সংগীতের প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্মে। পরবর্তীতে মায়ের উৎসাহ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তিনি সংগীত চর্চা শুরু করেন। ওস্তাদ অমর চন্দ্র শীল, ওস্তাদ অশ্বিনী কুমার রায়, সুখেন্দু চক্রবর্তী ও নিতাই রায়ের কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে জেলাভিত্তিক সংগীত প্রতিযোগিতায় বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার হয়ে দুইবার চ্যাম্পিয়ন হন বিপুল ভট্টাচার্য।
১৯৬৭ সালে, পূর্ব পাকিস্তান সংগীত প্রতিযোগিতায়, নজরুল সংগীতে প্রথম হন ও গোল্ড মেডেল পান।
১৯৬৯ সালে, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় পল্লীগীতিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন ও ‘স্বর্ণপদক’ জয় করেন তিনি। সেই সময়ে বিপুল ভট্টাচার্যকে নিয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখা-লেখি হয়।
১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বিপুল ভট্টাচার্যও যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়ে তিনি, মেশিনগানের বিরুদ্ধে তাঁর গান এবং কন্ঠ দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। লাখো মুক্তিযোদ্ধার মনে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছেন।
যুদ্ধের সময়ে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থার ব্যানারে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে ট্রাকে করে শরণার্থী শিবির গুলোতেগান নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন মাইলের পর মাইল। শরণার্থী শিবির, মুক্তি ফৌজের ক্যাম্পে এবং মুক্তাঞ্চলে গান গেয়ে বেড়াতেন তাঁরা। যা আমরা ১৯৯৩ সালে দেখতে পাই তারেক মাসুদের ‘মুক্তির গান’-এ।
বিপুল ভট্টাচার্য, রেডিও টেলিভিশন ছাড়াও গান গেয়েছেন চলচ্চিত্রেও। তিনি যেসব চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন তারমধ্যে- শ্রীমতী ৪২০, রাখে আল্লাহ মারে কে, সোনার তরী, মাটির পুতুল, গুনাই বিবি, বড় ভালো লোক ছিলো, বাঙলা, উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারে নিয়মিত শিল্পী হিসেবে সংগীত পরিবেশন করতেন বিপুল ভট্টাচার্য। বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপানসহ অনেক দেশ সফর করেছেন। ‘মল্লিকা সংগীত সমারোহ বিদ্যায়তনে’র প্রতিষ্ঠাতা তিনি।
বিপুল ভট্টাচার্য ১৯৭৫ সালে বিয়ে করেন। তাঁর সহধর্মিণীর নাম কুমকুম ভট্টাচার্য। তাদের দুই সন্তান, ছেলে পার্থ ভট্টাচার্য ও মেয়ে মল্লিকা ভট্টাচার্য।
বাংলাদেশ বেতারের প্রযোজক, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন বিপুল ভট্টাচার্য। কৈশোরেই তিনি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। স্বর্ণপদক জয় করেছেন বিভিন্ন সংগীত প্রতিযোগিতায়। একাত্তরেও পাক বর্বরতায় ফুঁসে উঠেছিলো তাঁর দরাজ কন্ঠ। স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়ে, দেশের কথা, মানুষের কথা, মু্ক্তির কথা বলে বেড়িয়েছেন সুরে সুরে- গলাছেড়ে নির্ভয়ে।
কিন্তু, এই সাহসী কণ্ঠশিল্পী-বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধিনতার পর কোনো সম্মান বা স্বীকৃতি পাননি। শেষ জীবনে তিনি গান শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন । একজন দেশপ্রেমী কন্ঠযোদ্ধা বুকভরা নিরব অভিমান নিয়ে চলে গেছেন অনন্তলোকে….।
কণ্ঠশিল্পী-বীর মুক্তিযোদ্ধা বিপুল ভট্টাচার্য এর প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম।