English

31.1 C
Dhaka
শুক্রবার, মে ১৬, ২০২৫
- Advertisement -

মহাপ্রয়াণের এক বছর: কিংবদন্তী গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার

- Advertisements -

এ কে আজাদ: গাজী মাজহারুল আনোয়ার। চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, কাহিনী-চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা, গীতিকার ও সুরকার। বাংলাদেশের সর্বাধিক গানের গীতিকার, সর্বাধিক জনপ্রিয় গানের গীতিকার, সর্বাধিক দেশাত্মবোধক গানের গীতিকার, সর্বাধিক চলচ্চিত্রের গানের গীতিকার তিনি।

বাংলাদেশের সঙ্গীতে সর্বকালের সেরা গীতিকবি হিসেবে অবিহিত করা যায় তাঁকে। অসম্ভব মেধাবী এই মানুষটি ছিলেন স্বভাবকবি, খুবই কম সময়ের মধ্যে গান লিখার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তাঁর। বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কিংবদন্তি গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। প্রয়াত এই গুণি ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার ১৯৪৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি, কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার তালেশ্বর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোজাম্মেল হোসেন, মাতার নাম খাদেজা বেগম। কুমিল্লা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। স্নাতক সম্পন্ন করেন ‘তোলারাম কলেজ’ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে।

১৯৬৪ সাল থেকে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের জন্য গান লেখা শুরু করেন। এদেশে টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই নিয়মিত গান ও নাটক রচনা করেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।
১৯৬৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত, চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘আয়না ও অবশিষ্ট’ চলচ্চিত্রের জন্য তিনি প্রথম গান লেখেন। এরপরে তিনি বহু চলচ্চিত্রে গান লিখেছেন এবং একজন কিংবদন্তি গীতিকবি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার যেসব চলচ্চিত্রে গান লিখেছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র- আবির্ভাব (১৯৬৮), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯), পীচ ঢালা পথ (১৯৭০), ক খ গ ঘ ঙ (১৯৭০), দীপ নেভে নাই (১৯৭০), দর্প চূর্ণ (১৯৭০), বিনিময় (১৯৭০), সাধারণ মেয়ে (১৯৭০), জয়বাংলা, স্বরলিপি (১৯৭১), অবুঝ মন (১৯৭২), ওরা ১১ জন, রংবাজ (১৯৭৩), বেঈমান (১৯৭৪), অনেক দিন আগে (১৯৭৪), চাষীর মেয়ে (১৯৭৫), উপহার(১৯৭৫), জয় পরাজয় (১৯৭৬), বন্দিনী (১৯৭৬), সূর্যগ্রহণ (১৯৭৬), দি রেইন (১৯৭৬), নয়নমণি (১৯৭৬), দস্যু বনহুর (১৯৭৬), গড়মিল(১৯৭৬), মণিহার (১৯৭৬), অনন্ত প্রেম (১৯৭৭), মতিমহল (১৯৭৭), গোলাপী এখন ট্রেনে (১৯৭৮), অশিক্ষিত (১৯৭৮), ডুমুরের ফুল (১৯৭৮), দি ফাদার (১৯৭৯), সূর্য সংগ্রাম (১৯৭৯), মহানগর (১৯৮১), অংশীদার, নান্টু ঘটক, লাল কাজল (১৯৮২), পুরস্কার (১৯৮৩), নতুন বউ (১৯৮৩) নাজমা (১৯৮৩), বানজারান, পেনশন (১৯৮৪), অভিযান (১৯৮৪), মা ও ছেলে (১৯৮৫), সারেন্ডার (১৯৮৭), রাজলক্ষী শ্রীকান্ত (১৯৮৭), যোগাযোগ (১৯৮৭), আগমন (১৯৮৭), রাঙা ভাবী (১৯৮৯), জীনের বাদশা (১৯৮৯), ছুটির ফাঁদে (১৯৯০), স্বাধীন(১৯৯০), অন্ধ বিশ্বাস (১৯৯২), ক্ষুধা, তুমি আমার (১৯৯৪), দেনমোহর (১৯৯৪), আশা ভালোবাসা (১৯৯৫), আঞ্জুমান (১৯৯৫), তপস্যা,
বাবার আদেশ (১৯৯৫), স্বপ্নের পৃথিবী (১৯৯৬), অজান্তে (১৯৯৬), দুর্জয় (১৯৯৬), তোমার জন্য পাগল (১৯৯৭), কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি (২০০৩), মান্না ভাই (২০০৪), হৃদয়ের কথা (২০০৬), বিদ্রোহী পদ্মা (২০০৬), তুমি কত সুন্দর (২০০৮), এ চোখে শুধু তুমি (২০০৮), বধূবরণ (২০০৮), যদি বউ সাজগো (২০০৮), তুমি আমার স্বামী (২০০৯), হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ (২০১১), রাজা সূর্য খাঁ (২০১২), জজ ব্যরিস্টার পুলিশ কমিশনার (২০১৩), নিঃস্বার্থ ভালোবাসা (২০১৩), পুত্র এখন পয়সাওয়ালা (২০১৫), বিগ ব্রাদার (২০১৫), লালচর (২০১৫), মাটির পরী (২০১৬) ইত্যাদি।

অসংখ্য জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ার। তিনি চলচ্চিত্র ছাড়াও লিখেছেন দেশাত্মবোধক ও আধুনিকসহ সবধরণের গান।

তাঁর গানে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, জীবনবোধ, প্রেম-বির, রাগ-অনুরাগ, কটাক্ষ, মানবতা, বিদ্রোহ, সামাজিক নাটকীয়তা’হসহ নানা অনুভূতির কথা। তাঁর লেখা জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের মধ্যে – নীল আকাশের নীচে আমি রাস্তা চলেছি একা…., আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার….,
ইশারায় শীষ দিয়ে….., তুমি হলে তুমি…., চোখের নজর এমনি কইরা…, যদি আমাকে দেখতে সাধ হয় বাংলার মুখ তুমি দেখে নিও…, চিঠি দিও প্রতিদিন চিঠি দিও…, একা একা কেন ভালো লাগে না…, পিচঢালা এ পথটারে ভালোবেসেছি…,আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে যেন সৈকতে পরে আছি…,তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো…, বিক্রমপুরে বাপের বাড়ি ছিল একদিন পদ্মার পাড়…, জয় বাংলা বাংলার জয়…, একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল…., একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়….., গানের খাতায় স্বরলিপি লিখে কী হবে…., তুমি আরেকবার আসিয়া যাও মোরে কাঁন্দাইয়া…, আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল…., নাচরে ওমন ধীতান ধীতান নাচ…., বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না…, এক নদীরই উজান ভাটি আমরা দু’টি ধারা…, মাগো তোর চরণতলে বেহেশত আমার…, আমরা তো বানজারান দেখাবো নাচ গান…, তোমারই পরশে জীবন আমার ওগো ধন্য হলো…., আমিতো বন্ধু মাতাল নই…., গীতিময় এইদিন চিরদিন রবে কি…., বলে দাও মাটির পৃথিবী কোথা শান্তি আমার জীবনে…., লোকে বলে রাগ নাকি অনুরাগের আয়না…, সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমেরে…, কারো আপন হইতে পারলিনা অন্তর…., হয় যদি বদনাম হোক আরো আমিতো এখন আর নই কারো…, কাছে এসো যদি বলো তবে দূরে কেন থাকো…, তুমি সাত সাগরের ওপাড় হতে আমায় ডেকেছো…., সুরের ভুবনে আমি আজো পথচারি…., হেসে খেলে জীবনটা যদি চলে যায়…., সবাইতো ভালবাসা চায় কেউ পায় কেউবা হারায়…, এই পথে পথে আম একা চলি…., প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

বিবিসি’র জরিপে সর্বকালের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে তিনটি গানের রচয়িতা গুণী এই গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। গানগুলো হচ্ছে- ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’ ও ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার চলচ্চিত্রের সাথে যুক্ত হওয়ার পর থেকেই গান লেখার পাশাপাশি কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপও লিখতে থাকেন সমানতালে। মানুষের মন, কাঁচের স্বর্গ, অপরাধ, গড়মিল, বেলা শেষের গান, সমাধি, বন্ধু, অবাক পৃথিবী, প্রতিনিধি, আসামী, জিঞ্জির, অন্তরালে, আনারকলি, বানজারান, স্বাধীন, তপস্যা, ক্ষুধা’সহ বহুসংখ্যক চলচ্চিত্রের কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ লিখেছেন তিনি।

এক সময় তিনি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনার সাথে যুক্ত হন। গাজী মাজহারুল আনোয়ার পরিচালিত
প্রথম চলচ্চিত্র ‘নান্টু ঘটক’ মুক্তি পায় ১৯৮২ সালে। তাঁর পরিচালিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে- শাস্তি, চোর, বিচারপতি, সন্ধি, স্বাক্ষর, শর্ত, স্বাধীন, সমর, শ্রদ্ধা, স্নেহ, আম্মা, পরাধীন, তপস্যা, উল্কা, ক্ষুধা, রাগী, আর্তনাদ, জীবনের গল্প, এই যে দুনিয়া, পাষানের প্রেম, হৃদয় ভাঙ্গা ঢেউ, অন্যতম।

তাঁর প্রযোজনা-পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘দেশ চিত্রকথা’। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি- সমাধান, স্বীকৃতি, গড়মিল, অগ্নিশিখা, সমাধি, অপরাধ, অনুরোধ, বন্ধু, জিঞ্জির, আনারকলি, নান্টু ঘটক, শাস্তি, বিচারপতি, স্বাক্ষর, সন্ধি, স্বাধীন, শর্ত, সমর, শ্রদ্ধা, ক্ষুধা, স্নেহ, তপস্যা, উল্কা, আম্মা, পরাধীন, আর্তনাদ, পাষাণের প্রেম, এই যে দুনিয়া প্রভৃতি চলচ্চিত্রগুলো প্রযোজনা করেছেন।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার তাঁর সৃজনশীল কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে, ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯২, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০২, ২০০৩ ও ২০১৭) অর্জন করেন।

২০০২ সালে একুশে পদক এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া একাধিকবার বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, বিজেএমই অ্যাওয়ার্ড, ডেইলি স্টার কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন তিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলাদেশ প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার এর জনপ্রিয় সব গান নিয়ে তিনখন্ডে তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। ‘অল্প কথার গল্প গান’ নামের প্রতিটি বইতে দুইশত’রও বেশী গানের কথা রয়েছে। একই সঙ্গে আছে জনপ্রিয় কালজয়ী সব গান রচনার প্রেক্ষাপট ও গান রচনার গল্প। বই তিনটি প্রকাশ করেছেন ‘ভাষাচিত্র’ প্রকাশনী থেকে খন্দকার মনিরুল ইসলাম সোহেল।

ব্যক্তিজীবনে গাজী মাজহারুল আনোয়ার এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের পিতা ছিলেন। তাঁর ছেলে-মেয়ে দু’জনই শিল্প-সংস্কৃতির সাথে জড়িত।

গাজী মাজহারুল আনোয়ার রাজনীতির সাথেও সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন, ছিলেন বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংগঠন (জাসাস) এর সাবেক সভাপতি এবং বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশের সঙ্গীতের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। বাংলা গানের বহুল জনপ্রিয় গীতিকার ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সংস্কৃতির এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র ছিলেন তিনি। দীর্ঘ কর্মময় জীবনে আমাদের সঙ্গীতভুবন সমৃদ্ধ করে গেছেন বিস্ময়করভাবে।

এদেশের চলচ্চিত্র ও সঙ্গীতের জননন্দিত-কিংবদন্তী ব্যক্তিতত্ব, অসংখ্য কালজয়ী অমর গানের গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার শারীরিকভাবে চলে গেলেও তাঁর কোটি কোটি ভক্ত-দর্শকদের বুকের মাঝে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল।

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন