নাসিম রুমি: বাংলা নাটকের ইতিহাসে যদি সবচেয়ে প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় লেখকের নাম বলতে হয় তাহলে নিঃসন্দেহে প্রথমেই উচ্চারিত হবে হুমায়ূন আহমেদের নাম। সাহিত্যজগতে বিপ্লব ঘটানোর পাশাপাশি তিনি ছোট পর্দাতেও সৃষ্টি করেছিলেন এক অনন্য জাদু। আশির দশক থেকে নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশনের দর্শকদের টেনে রেখেছিলেন একের পর এক সামাজিক, রোমান্টিক ও হাস্যরসাত্মক নাটকের মধ্য দিয়ে। তাকে টিভি নাটকের ইতিহাসে একজন যুগস্রষ্টা হিসেবে সম্মানিত করা হয়।
খন্ড ও ধারাবাহিক মিলিয়ে শত শত নাটক প্রচার হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের লেখা ও নির্মিত। সেখান থেকে সেরা পাঁচটি নাটক বাছাই করা সত্যি সমুদ্রে সুঁই খোঁজবার মতো। তবে হুমায়ূন ভক্তরা নাটক নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে তার ধারাবাহিকগুলোকেই সবসময় এগিয়ে রাখেন। সেই বিবেচনায় হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুবার্ষিকীতে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তুলে ধরা হলো তেমন পাঁচটি নাটকের কথা যেগুলো আজও দর্শকের হৃদয়ে গেঁথে আছে অমলিনভাবে।
অমর বাকের ভাইয়ের ‘কোথাও কেউ নেই’ (১৯৯০)
হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটক হিসেবে ‘কোথাও কেউ নেই’ একটি ইতিহাস। এই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র বাকের ভাই। এতে অভিনয় করে আসাদুজ্জামান নূর হয়ে উঠেছিলেন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।
বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথমবার এটিই একটি চরিত্র যার জন্য জনমানুষ অবাস্তব আবেগ দেখিয়েছে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসির রায় বাস্তবে না দেওয়ার দাবি তুলে রাস্তায় নেমেছিল দর্শক। পত্র পত্রিকায় হয়েছিল লেখালেখি। এই নাটক প্রমাণ করেছিল, গল্প বলার শক্তি মানুষকে কিভাবে বাস্তবতার চেয়েও বেশি বিশ্বাসী করে তুলতে পারে। এই নাটক হুমায়ূন আহমেদের লেখা, নির্মিত নয়। এটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন বরকত উল্লাহ। এতে আসাদুজ্জামান নূর, সুবর্ণা মুস্তাফা, আব্দুল কাদের, লুৎফর রহমান জর্জ, মাহফুজ আহমেদ, আফসানা মিমি ও হুমায়ুন ফরীদির মতো তারকারা অভিনয় করেছেন।
শুরু থেকেই জয়যাত্রার ‘এইসব দিনরাত্রি’ (১৯৮৫)
হুমায়ূন আহমেদের কোনো সৃষ্টি নিয়ে প্রথম ধারাবাহিক নাটক ‘এইসব দিনরাত্রি’। এটি ছিল এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সহজ-সরল জীবনের কাহিনি। সেখানে ছিল আনন্দ, দুঃখ, স্বপ্ন আর বাস্তবতার করুণ চিত্র। মুস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত নাটকটিতে চরিত্রগুলোর স্বাভাবিক আচরণ এবং সংলাপের বাস্তবধর্মী ভাষা দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।
এ নাটকের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দর্শক টেলিভিশনে ‘ঘরের গল্প’ দেখতে পান যেখানে কল্পনার চেয়ে বাস্তবতা ছিল বেশি। বুলবুল আহমেদ, ডলি জহুর, আসাদুজ্জামান নূর, ইনামুল হক, খালেদ খান, লুৎফুন নাহার লতা, দিলারা জামানরা দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন।
হাস্যরসের আড়ালে সমাজের আয়না ‘বহুব্রীহি’ (১৯৮৮)
‘বহুব্রীহি’ হুমায়ূন আহমেদের লেখা অন্যতম সেরা সৃষ্টি। হাস্যরসাত্মক নাটকটি শুধু মজার গল্পই বলেনি, সমাজের ভেতরের নানা অসঙ্গতি, কুসংস্কার এবং মানবিক বোধের কথাও তুলে ধরেছে সূক্ষ্মভাবে। নাটকের চরিত্রগুলোও হয়েছে কালজয়। বিশেষ করে নাটকের ফরিদ মামার চরিত্রে আলী যাকেরের অভিনয় আজও মুগ্ধ করে সবাইকে।
এ নাটক প্রমাণ করেছে, হাসির মধ্যেও গভীর চিন্তা লুকিয়ে থাকতে পারে। আর এটিই হুমায়ূন আহমেদের এক অসামান্য বৈশিষ্ট্য। নাটকে আবুল হায়াত, আলেয়া ফেরদৌসি, আলী যাকের, লুৎফুন নাহার লতা, আসাদুজ্জামান নূর, আফজাল শরীফ, লাকী ইনাম, আফজাল হোসেন, আবুল খায়ের প্রমুখেরা অভিনয়ের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন।
টিভি নাটকের অসামান্য সংযোজন ‘নক্ষত্রের রাত’ (১৯৯৬)
হুমায়ূন আহমেদ কত বড় দার্শনিক ছিলেন তার প্রমাণ অনেক সাহিত্যেই তিনি দিয়েছেন। তবে ‘নক্ষত্রের রাত’ গল্পের হাসান চরিত্রটি একজন দার্শনিকের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ এক সৃষ্টি হয়ে থাকবে। অনেকে মনে করেন হাসান চরিত্রটি মূলত হুমায়ূন আহমেদ নিজেই। রহস্যময়, জটিল কিন্তু সহজ চিন্তার এক যুবক। যার আগমনে একটি বাড়িতে ঘটে যায় নানা রকম পরিবর্তন। বরাবরের মতো হাস্যরসের আড়ালে আবারও হুমায়ূন এই গল্পে মনস্তাত্ত্বিক এবং আবেগী মধ্যবিত্তের জীবনকে তুলে এনেছেন।
নাটকটিতে হাসান চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূরের অভিনয় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে। আরও অভিনয় করেছেন সারা যাকের, জাহিদ হাসান, আফসানা মিমি, আজিজুল হাকিম, শমী কায়সার, আবুল হায়াত, দিলারা জামান, লাকী ইনাম, আবদুল কাদের, মেহের আফরোজ শাওন ও শিলা আহমেদের মতো একঝাঁক তারকা।
রসিকতা ও পারিবারিক বন্ধনের ‘আজ রবিবার’ (১৯৯৯)
একটা নাটকের সবগুলো চরিত্রই জনপ্রিয় কিংবা অজস্র সংলাপ মানুষের মুখে মুখে ফেরে- এমনটা খুব কমই দেখা যায়। সেই ব্যতিক্রমী ঘটনাটিই ঘটিয়েছে ‘আজ রবিবার’। আনিস ভাইয়া, কঙ্কা-তিতলী, দাদাজান, বড় চাচা, হিমু চাচা, বাবা, মীরা, মতি মিয়া, ফুলি, বাকের ভাইরুপী আসাদুজ্জামান নূর- এ নাটকের প্রতিটি চরিত্রই আজও দর্শকের প্রিয়। এখনো চোখের সামনে যে কোনো চরিত্রের সংলাপ ভেসে এলে কেউ চোখ ফেরাতে পারেন না। সংলাপের যেমন আছে মুন্সিয়ানা তেমনি প্রতিটি শিল্পীই যার যার চরিত্রে নিজেকে অনন্য করে তুলেছিলেন বলেই হয়তো এমনটা সম্ভব হয়েছে।
সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের সবচেয়ে প্রাণবন্ত ও প্রাণচঞ্চল নাটকগুলোর একটি। এটি ছিল একটি পরিবারের সদস্যদের মজার-মজার দ্বন্দ্ব, আবদার ও আবেগে ভরা রঙ্গময় প্রতিচ্ছবি। আবুল খায়ের, আবুল হায়াত, আসাদুজ্জামান নূর, জাহিদ হাসান, সুবর্ণা মুস্তাফা, আলী যাকের, মেহের আফরোজ শাওন, শিলা আহমেদ, ফারুক আহমেদরা দারুণ অভিনয় করেছেন নাটকটিতে।
এছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুদিনে আজ দেখতে পারেন তার লেখা ও নির্মিত আরও কিছু নাটক। যেমন ‘অয়োময়’, ‘জোছনার ফুল’, ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’, ‘সেদিন চৈত্র মাস’, ‘এই মেঘ এই রৌদ্র’, ‘কালা কইতর’, ‘নীতু তোমাকে ভালোবাসি’, ‘সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড’, ‘পুষ্প কথা’, ‘হাবলঙ্গের বাজার’, ‘বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল’, ‘চৈত্র দিনের গান’ ইত্যাদি নাটকগুলো।