এ কে আজাদ: সিবি জামান। চলচ্চিত্র পরিচালক-অভিনেতা। সামাজিক গল্পনির্ভর চলচ্চিত্রের অন্যতম সফল নির্মাতা তিনি। পরিচালনা করে গেছেন ব্যবসাসফল ও জনপ্রিয় সব সুস্থ-বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র । একজন ভালো চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে যেমন পরিচিতি ছিল তাঁর, তেমনি একজন ভালো মানুষ হিসেবে ছিলেন সমাদৃত ।
এই স্বনামখ্যাত চিত্রপরিচালক সি বি জামান-এর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী আজ । তিনি ২০২৪ সালের ২০ ডিসেম্বর, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর। প্রয়াত এই গুণি চিত্রপরিচালকের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
সি বি জামান (চৌধুরী বদরুজ্জামান) ১৯৪১ সালের ১৪ আগস্ট, ভারতে আসামের গৌরীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজার চারখাই ইউনিয়নের গোলাঘাট গ্রামে। তাঁর বাবার নাম ইমাদুর রহমান চৌধুরী ও মায়ের নাম শরীফা খাতুন। বাবার কর্মসূত্রে গোয়ালপাড়া, ধুবড়ি, আটারী ঘাট, ঠাকুরবাড়ি, তেজপুরসহ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় তাঁর শৈশব অতিবাহিত হয়। ১৯৪৭ সালে, দেশভাগের পরে তাঁর বাবা ট্রান্সফার হয়ে হবিগঞ্জে পোস্ট মাস্টার হয়ে আসেন। ১৯৪৮ সালে, হবিগঞ্জ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ছয় ভাই বোনের মধ্যে সি বি জামান ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর ছোট ভাই খায়রুজ্জামান চৌধুরী ছিলেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান। ১৯৬৩ সালে, সিলেট এমসি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করে সি বি জামান ফুড ইন্সপেক্টর হিসেবে চাকুরি করেন চট্টগ্রামে।
ঢাকায় নির্মিত, কলিম শরাফী ও জহির রায়হানের “সোনার কাজল” চলচ্চিত্রে সহকারী হিসেবে প্রথম কাজ করেন সি বি জামান। ১৯৬৫ সালে, চাকুরি ছেড়ে লাহোরে চলে যান। ওখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে চিত্রপরিচালক এস এ বোখারীর সহকারী হিসেবে পাঞ্জাবি ছবি “পাগলী সামাল যাঁয়েগা” নামক ছবিতে কাজ শুরু করেন। লাহোরে তিনি আরো কাজ করেছেন চিত্রপরিচালক হাসান তারিক ও শামীম আশরাফ মালিকের সহকারী হিসেবেও।
সেই সময়ে ঢাকা থেকে চলচ্চিত্রের গান রেকর্ডিংসহ বিভিন্ন কারিগরি কাজে অনেকেই লাহোর স্টুডিওতে গিয়ে কাজ করতেন। খান আতাউর রহমান ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ উর্দু ভার্সনে পাকিস্তানে রিলিজ করার জন্য গেলে সি বি জামানের সাথে তাঁর পরিচয় হয় এবং ঢাকায় চলে এসে খান আতাউর রহমানের সাথে কাজ শুরু করেন।
সি বি জামান পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘ঝড়ের পাখি’ মুক্তিপায় ১৯৭৩ সালে। তাঁর পরিচালনায় অন্যান্য চলচ্চিত্র- উজান ভাটি, পুরস্কার, শুভরাত্রি, হাসি, লাল গোলাপ, কুসুম কলি অন্যতম।
সিবি জামান পরিচালিত শিশুতোষ চলচ্চিত্র ‘পুরস্কার’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ পাঁচটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের ‘গোয়া চলচ্চিত্র উৎসব’, ‘দিল্লী আন্তর্জাতিক উৎসব’ ও রাশিয়ার ‘তাশখান্দ চলচ্চিত্র উৎসব’-এ প্রদর্শন করা হয়।
চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমানের সঙ্গে ‘সাত ভাই চম্পা’ থেকে শুরু করে ‘এখনো অনেক রাত’ পর্যন্ত সব ছবিতেই সম্পৃক্ত ছিলেন সি বি জামান।
খান আতা, তাহের চৌধুরী ও সি বি জামান- এই ত্রয়ী মিলে ‘প্রমোদকার’ নামের আড়ালে একত্রে পরিচালনা করেছিলেন ‘ত্রিরত্ন’, ‘সুজন-সখী’, ‘দিন যায় কথা থাকে’ ও ‘হিসাব নিকাশ’ নামের এই চারটি চলচ্চিত্র।
এছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি স্বল্প-দৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তাঁর নির্মিত ‘রাজা বাদশা’ চলচ্চিত্রটি শ্যুটিং শেষ হওয়া সত্ত্বেও প্রযোজকদের কারণে মুক্তি পায়নি।
সি বি জামান চলচ্চিত্র পরিচালক ছাড়াও একজন অভিনেতা। তিনি বেশকিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন যারমধ্যে- অরুণ বরুণ কিরণ মালা, ইয়ে করে বিয়ে, চেনা অচেনা, দিন যায় কথা থাকে, ত্রিরত্ন, ঝড়, এক খণ্ড জমি, ভালবাসা ভালবাসা, ১ টাকার বউ, টিপ টিপ বৃষ্টি, আমার জান আমার প্রাণ, আমার প্রাণের প্রিয়া, আমার স্বপ্ন আমার সংসার, বাজাও বিয়ের বাজনা, দারোয়ানের ছেলে, মধুমতি,
মনের ঘরে বসত করে, মানিক রতন দুই ভাই, এক মন এক প্রাণ, প্রিয়া তুমি সুখী হও, লোভে পাপ পাপে মৃত্যু, নীল আঁচল, ভালোবাসার শেষ নেই, বিয়ের প্রস্তাব উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও তিনি কয়েকটি বিজ্ঞাপনচিত্রেও অভিনয় করেছেন।
২০১৬ সালে, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ সি বি জামানকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টেশন তৈরি করে।
সামাজিক ছবির সুনির্মাতা সি বি জামান, সদা হাসিমুখ-স্বল্পভাষী ও একজন ভদ্রলোক হিসেবে চলচ্চিত্র শিল্পের সকলের কাছেই ছিলেন প্রিয় একজন মানুষ।
