English

32.1 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, আগস্ট ২১, ২০২৫
- Advertisement -

স্মরণে শ্রদ্ধায় ভালোবাসায়: বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নায়করাজ রাজ্জাক

- Advertisements -

এ কে আজাদ: রাজ্জাক। নায়করাজ রাজ্জাক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সর্বকালের সেরা চিত্রনায়ক। একজন প্রতিভাবান সৃজনশীল মেধাবী অভিনেতা।নায়করাজ রাজ্জাক বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের ভিন্ন ভিন্ন ডাইম্যানশনে হাজির হয়েছেন সিনেমাদর্শকদের সামনে। তাঁর সময়ের প্রায় সব চিত্রনায়িকার সাথেই জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন এবং সফল হয়েছেন। অসংখ্য বাণিজ্যসফল চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন তিনি ।

আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে সুদৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করাতে নায়করাজ রাজ্জাক বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী অভিনেতা নায়করাজ রাজ্জাক-এর চলে যাওয়ার আট বছর আজ। তিনি ২০১৭ সালের ২১ আগস্ট, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। প্রয়াত নায়করাজ-এর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

নায়ক রাজ্জাক (আবদুর রাজ্জাক) ১৯৪২ সালের ২৩ জানুয়ারি, পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ কলকাতার টালিগঞ্জে, জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আকবর হোসেন। মায়ের নাম নিসারুননেছা। তিনি কলকাতার খানপুর হাইস্কুলে পড়া-লেখা করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালিন সময়ে, সরস্বতী পূজায় শিশু-কিশোরদের নিয়ে লেখা মঞ্চ নাটক ‘বিদ্রোহী’তে অভিনয় করেন। এভাবেই রাজ্জাকের অভিনয়ের সাথে সম্পৃক্ততা হয়। তখন থেকেই তাঁর অভিনয়ের প্রতি প্রচন্ড ভালো লাগা-ভালোবাসা জন্মায়।
কলেজে পড়ার সময়ে ‘রতনলাল বাঙ্গালী’ নামে একটি চলচ্চিত্রের জন্য ক্যামেরার সামনে প্রথম অভিনয় করেন– তবে ছবিটি বহু পরে ১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় ‘আমি রতন’ নামে।

১৯৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল, পরিবার নিয়ে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন রাজ্জাক । তখন তাঁর সাথে ছিল, স্ত্রী লক্ষ্মী ও পুত্র বাপ্পারাজ। তাঁর অভিনয়ের গুরু পীযূষ বসুর দেয়া একটি চিঠি নিয়ে তিনি, পরিচালক আব্দুল জব্বার খানের সাথে দেখা করেন ঢাকার কমলাপুরে। আব্দুল জব্বার খানই তাঁকে ইকবাল ফিল্মস-এ কাজ করার সুযোগ করে দেন। ১৯৬৪ সালেই রাজ্জাক সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘উজালা’ চলচ্চিত্রে কামাল আহমেদের সাথে কাজ করা শুরু করেন। সহকারী পরিচালক হিসেবে তাঁর দ্বিতীয় ছবি ছিল ‘পরওয়ানা’। সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি- আখেরী স্টেশন, ১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন, কার বউ, ডাক বাবু এসব চলচ্চিত্রে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এর মাঝে রাজ্জাক টেলিভিশনে ‘ঘরোয়া’ নামের একটি ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করে বেশ পরিচিতি পান।
নায়ক হিসেবে রাজ্জাকের প্রথম ছবি ‘বেহুলা’। জহির রায়হান পরিচালিত ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত করে ফেলেন রাজ্জাক। শুরু হয় যায় বাংলাদেশে নায়করাজ রাজ্জাক ইতিহাস।
নায়করাজ রাজ্জাক অভিনীত চলচ্চিত্রসমূহ- আগুন নিয়ে খেলা, আনোয়ারা, জুলেখা, নিশি হলো ভোর, দুই ভাই, আবির্ভাব, এতটুকু আশা, সখিনা, সুয়োরাণী দুয়োরাণী, বাঁশরী, মনের মতো বউ, ময়না মতি, আগন্তুক, নীল আকাশের নিচে, শেষ পর্যন্ত, মেহেরবান, যে আগুনে পুড়ি, ক খ গ ঘ ঙ, আঁকা বাঁকা, জীবন থেকে নেয়া, পীচঢালা পথ, যোগ বিয়োগ, দর্পচুর্ণ, মধুমিলন, ঢেউয়ের পর ঢেউ, টাকা আনা পাই, কাঁচ কাটা হীরে, দ্বীপ নেভে নাই, ছদ্মবেশী, অধিকার, নাচের পুতুল, জীবন থেকে নেয়া, স্বরলিপি, স্মৃতিটুকু থাক, গাঁয়ের বধূ, মনের মতো মন, অশ্রু দিয়ে লেখা, এরাও মানুষ, ওরা ১১ জন, ছন্দ হারিয়ে গেল, অবুঝ মন, মানুষের মন, কমলরাণীর দীঘি, প্রতিশোধ, চৌধুরী বাড়ি, জীবন সঙ্গী, রংবাজ, ঝড়ের পাখি, পলাতক, প্রিয়তমা, স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা, কে তুমি, অনির্বাণ, আমার জন্মভূমি, স্লোগান, অতিথি, জীবন তৃষ্ণা, খেলাঘর, আলোর মিছিল, ভুল যখন ভাঙল, বেঈমান, অবাক পৃথিবী, চোখের জলে, বাঁদী থেকে বেগম, আলো তুমি আলেয়া, আপনজন, ডাক পিয়ন, উপহার, অনেক প্রেম অনেক জ্বালা, কি যে করি, গুন্ডা, মায়ার বাঁধন, প্রতিনিধি, সমাধি, আকাঙক্ষা, স্মাগলার, শাপমুক্তি, সেতু, অনুরোধ, আগুন, অমর প্রেম, অনন্ত প্রেম, মতি মহল, যাদুর বাঁশি, অশিক্ষিত, সোহাগ, অঙ্গার, অগ্নিশিখা, আসামী, কাপুরুষ, বাজিমাৎ, অলংকার, জিঞ্জির, অনুরাগ, আয়না, মাটির ঘর, সোনার চেয়ে দামী, বদলা, অভিমান, রাজবন্দী, সোনার হরিণ, জোকার, ছুটির ঘণ্টা, আনারকলি, সখী তুমি কার, গাঁয়ের ছেলে, বৌ রাণী, মহানগর, অংশীদার, দুই পয়সার আলতা, বড় ভাল লোক ছিল, রজনীগন্ধা, রাজা সাহেব, আশার আলো, নাজমা, লালু ভুলু, লাইলি মজনু, বদনাম, কালো গোলাপ, চন্দ্রনাথ, অভিযান, নতুন পৃথিবী, গৃহলক্ষ্মী, অসাধারণ, চোর, সৎ ভাই, ন্যায় বিচার, কাবিন, শুভদা, আওয়ারা, অভাগী, ফুলশয্যা, রাজলক্ষী ও শ্রীকান্ত, স্বামী-স্ত্রী, সন্ধি, যোগাযোগ, ঢাকা- ৮৬, নীতিবান, কুসুমপুরের কদম আলী, স্বাক্ষর, রাম রহিম জন, দুর্নাম, বিরহ ব্যথা, রাজা মিস্ত্রি, সহধর্মিণী, দেবর ভাবী, মালামতি, সম্মান, অন্ধ বিশ্বাস, দরবারে-এ-খাজা, প্রফেসর, জন্মদাতা, মিস্টার মাওলা, জনম দুখী, সতীনের সংসার, জজসাহেব, বাবা কেন চাকর, উত্তর ফাল্গুনী, শান্ত কেন মাস্তান, মরণ নিয়ে খেলা, মেজর সাহেব, কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি, আমাদের সন্তান, কোটি টাকার কাবিন, পিতামাতার আমানত, চাচ্চু আমার চাচ্চু, রিকশাওয়ালার ছেলে, ভালোবাসার রঙ, আয়না কাহিনী, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেম কাহিনী, আকাশ কত দূরে, ইত্যাদি।

চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযোজক হিসেবেও নায়ক রাজ্জাক পেয়েছেন সফলতা, রেখেছেন তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর প্রযোজিত ও পরিচালিত ছবি- আকাঙক্ষা, অনন্ত প্রেম, পাগলা রাজা, বেঈমান, জোকার, বদনাম, অভিযান, সৎ ভাই, চাঁপাডাঙ্গার বউ, মৌ চোর, ঢাকা-৮৬, জ্বীনের বাদশা, প্রফেসর, রাজা মিস্ত্রী, মালামতি, বাবা কেন চাকর, উত্তর ফাল্গুনী, প্রেমশক্তি, মরণ নিয়ে খেলা, সন্তান যখন শত্রু, প্রেমের নাম বেদনা, আমি বাঁচতে চাই, কোটি টাকার ফকির, মন দিয়েছি তোমাকে, আয়না কাহিনী, প্রভৃতি।

নায়করাজ রাজ্জাক তাঁর বর্ণাঢ্য অভিনয়জীবনে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘কি যে করি’ (১৯৭৬), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘অশিক্ষিত’ (১৯৭৮), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘বড় ভালো লোক ছিল’ ( ১৯৮২), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা-ছবি চন্দ্রনাথ (১৯৮৪), শ্রেষ্ঠ অভিনেতা- ছবি ‘যোগাযোগ’ (১৯৮৮), চলচ্চিত্রে সামগ্রিক অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা-২০১৩।
রাস্ট্রীয়ভাবে পেয়েছেন স্বাধীনতা পুরস্কার-২০১৫।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ‘চ্যানেল আই চলচ্চিত্র মেলা-২০০৯’, পুরো রাজ্জাক পরিবারকে সম্মাননা প্রদান করে। অভিনেতা রাজ্জাকের বিশেষ অর্জন জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করা। এছাড়াও তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।

ব্যক্তিজীবনে নায়করাজ রাজ্জাক ১৯৬২ সালে, খায়রুন নেসা লক্ষ্মী’র সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের পাঁচ সন্তান। নায়ক বাপ্পারাজ (রেজাউল করিম), নাসরিন পাশা শম্পা, রওশন হোসাইন বাপ্পি, আফরিন আলম ময়না ও নায়ক সম্রাট (খালিদ হোসাইন)।

নায়করাজ রাজ্জাক একজন প্রতিভাবান সৃজনশীল মেধাবী অভিনেতা। রোমান্টিক প্রেমিক থেকে শুরু করে, গুন্ডা, আসামী, রংবাজ, দারোয়ান, দপ্তরী, চোর, বড় ভাই, শিক্ষক, প্রফেসর, জজ সাহেব, পুলিশ অফিসার, মৌয়াল, কৃষক, মাঝি, অন্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজা-বাদশা, ডাকাত, ড্রাইভার, ডাক্তার, মাতাল, পাগল, ক্যাবারে ড্যান্সার, ডাকপিওন, জুয়াড়ি, বাবা, দাদা’সহ বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে তাঁকে নিয়ে নির্মাতারা নানা ধরণের এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন এবং সফলও হয়েছেন।

নায়করাজ রাজ্জাক বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের ভিন্ন ভিন্ন ডায়ম্যানশনে হাজির হয়েছেন সিনেমাদর্শকদের সামনে। যখন যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন মানিয়ে গেছেন-উৎড়ে গেছেন বেশ ভালোভাবেই।
তাঁর সময়ের প্রায় সব নায়িকার সাথেই জুটি বেঁধে অভিনয় করেছেন এবং সফল হয়েছেন। তবে রাজ্জাক-কবরী জুটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় সেসময়ে। এই জুটি দর্শক হৃদয়ে চিরস্বরণীয় হয়ে আছে এখনো।

অসংখ্য হিট-সুপারহিট ছবির নায়ক, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেতা, যিনি পেয়েছেন নায়করাজ-এর খেতাব । পেয়েছেন অর্থ, যশ, খ্যাতি, সম্মান, দর্শকদের অকৃত্রিম ভালোবাসা। চলচ্চিত্রের প্রতিটি মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন আজীবন।

আমাদের দেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে বাণিজ্যিকভাবে সুদৃঢ় ভিতের উপর দাঁড় করাতে নায়করাজ রাজ্জাক বিশেষ অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের সিনেমার যথার্থ আধুনিক চিত্রনায়ক হিসেবে জয় করে নিয়েছেন কোটি মানুষের ভালোবাসা। যে ভালোবাসা মৃত্যুতে শেষ হয় না। যে ভালোবাসার মৃত্যু হয় না। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে নায়ককুলের রাজা, নায়করাজ রাজ্জাক কোটি মানুষের ভালোবাসায় চিরঞ্জীব।

The short URL of the present article is: https://www.nirapadnews.com/44r2
Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন