হাজার বছরের সঙ্গী হলেও মানুষের সঙ্গে বিড়ালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নাকি মোটেই তেমন পুরনো নয়। নতুন বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বলছে, বন্য শিকারি থেকে গৃহপালিত পোষা প্রাণীতে বিড়ালের রূপান্তর ঘটেছিল মাত্র সাড়ে তিন থেকে চার হাজার বছর আগে। আর এই পরিবর্তনের কেন্দ্র বলা হচ্ছে উত্তর আফ্রিকা, বিশেষ করে প্রাচীন মিশরকে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর গ্রেগর লার্সন বলেন, ‘টিভি প্রোগ্রাম থেকে সামাজিক মাধ্যম, বিড়াল আজ সর্বত্র। তাদের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া। অথচ মানুষের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সত্যিকারের শুরুটা হয়েছে মাত্র কয়েক হাজার বছর আগে, ১০ হাজার বছর আগে নয়।’
গবেষকদের দাবি, আধুনিক সব গৃহপালিত বিড়ালের উৎপত্তি আফ্রিকার বন্য বিড়াল প্রজাতি থেকে। কবে, কোথায় আর কীভাবে তারা বন্য স্বভাব হারিয়ে মানুষের ঘনিষ্ঠ সঙ্গী হয়ে উঠল—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বিজ্ঞানীরা ইউরোপ, উত্তর আফ্রিকা ও আনাতোলিয়ার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানে পাওয়া বিড়ালের হাড় পরীক্ষা করেন।
ডিএনএ বিশ্লেষণ আর বয়স নির্ধারণের মাধ্যমে তারা আধুনিক বিড়ালের জিনগত তথ্যের সঙ্গে এসব নমুনার তুলনা করেন। ফলাফল বলছে, কৃষির সূচনালগ্নে লেভান্ট অঞ্চলে বিড়ালের গৃহপালন শুরু হয়নি। বরং কয়েক সহস্রাব্দ পরে, উত্তর আফ্রিকায় এর সূচনা। প্রফেসর লার্সন বলেন, ‘এটা অনেক বেশি মিশরীয় ঘটনা বলে বোঝা যাচ্ছে। কৃষিকেন্দ্রিক প্রাচীন বসতি অঞ্চলের বদলে মিশরেই মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।’
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতা বিড়ালকে দেবত্বের মর্যাদা দিত। ভাস্কর্যে তাদের স্থান, মমি বানানোর ঐতিহ্য—সবকিছুই সেই সম্পর্ককে দৃঢ় করেছে। মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর জাহাজে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে ও সঙ্গী প্রাণী হিসেবে বিড়াল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে। গবেষণায় জানা গেছে, ইউরোপে বিড়ালের আগমন মাত্র ২ হাজার বছর আগে, রোমানদের মাধ্যমে। এরপর সিল্ক রোড ধরে তারা পৌঁছে যায় চীনেও। আজ অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া পৃথিবীর সব মহাদেশেই বিড়ালের উপস্থিতি দেখা যায়।
গবেষণায় একটি চমকও মিলেছে। আধুনিক গৃহপালিত বিড়ালের বহু আগে, চীনে মানুষ বসতিকে কেন্দ্র করে আরেক ধরনের বন্য বিড়াল কিছু সময় মানুষের পাশে থেকেছে। ‘লেপার্ড ক্যাট’। ছোট আকৃতির, চিতাবাঘের মতো দাগওয়ালা এই বন্য বিড়াল মানুষের বাসস্থানের কাছে ৩,৫০০ বছর ধরে বিচরণ করত। বেইজিংয়ের পেকিং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর শু-জিন লুও বলেন, ‘মানুষের সঙ্গে লেপার্ড ক্যাটের সম্পর্ক ছিল সম্পূর্ণ সহাবস্থানমূলক। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি; আর লেপার্ড ক্যাট পেয়েছে খাবারের সুযোগ। তবে তারা কখনোই পুরোপুরি গৃহপালিত হয়নি, আজও পুরো এশিয়া জুড়ে বুনো অবস্থায় বাস করে।’
অদ্ভুতভাবে, এই লেপার্ড ক্যাটকে পরে আধুনিক গৃহপালিত বিড়ালের সঙ্গে ক্রস-ব্রিড করে তৈরি হয়েছে জনপ্রিয় ‘বেঙ্গল ক্যাট’। ১৯৮০-এর দশকে একে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
বর্তমান সময়ের তথ্য অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রায় ৪০০টি ভিন্ন ভিন্ন বিড়াল ব্রিড পরিচিত। এর মধ্যে কয়েকটি প্রধান ব্রিডের বৈশিষ্ট্য এবং পাওয়া যাওয়া দেশ হলো:
- পারসিয়ান: দীর্ঘ লোম, শান্ত স্বভাব, মূলত ইরান থেকে।
- সিয়ামিজ: পাতলা দেহ, নীল চোখ, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া।
- মেইন কুন: বড় আকৃতির, শক্তিশালী, মূলত আমেরিকা।
- বেঙ্গল ক্যাট: দাগ ও বন্য চিতার মতো রঙ, আফ্রিকা ও আমেরিকা।
- রাগডল: শান্ত এবং আদরপ্রিয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
- ব্রিটিশ শর্টহেয়ার: মসৃণ লোম, ভারী গঠন, যুক্তরাজ্য।
- অ্যারাবিয়ান শো ক্যাট: দৃষ্টিনন্দন, আরব অঞ্চলে।
বিশ্বজুড়ে এই বিড়াল ব্রিডগুলো পোষা প্রাণী হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল অনুযায়ী দাম, পরিচর্যা এবং জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে আলাদা আলাদা প্রাধান্য পেয়েছে।
