English

25.2 C
Dhaka
শনিবার, অক্টোবর ১১, ২০২৫
- Advertisement -

মানবদেহের সুস্থতায় দৈনিক ডিম হোক ওষুধের বিকল্প

- Advertisements -

ড. মো. সাজেদুল করিম সরকার: ডিম হলো আমাদের খুব পরিচিত সব রকমের পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি প্রাকৃতিক খাবার। ডিমকে আমিষ ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাওয়ার হাউজ বলা হয়। সব বয়সের মানুষের জন্য ডিম অত্যন্ত উপকারী খাদ্য। তাই আমাদের সুস্থ্যতার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে একটি করে ডিম খাওয়া আবশ্যক। ডিমে প্রায় সব রকম ভিটামিন ও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট থাকায় বিজ্ঞানীরা একে সুপারফুড হিসেবে বিবেচনা করছেন। তাই তারা শিশুসহ সব বয়সীদের বেশি পরিমাণে ডিম খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে উন্নত বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশে সুপারফুড খাওয়ার প্রবণতা কম। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, পুষ্টিহীনতার কারণে শিশুরা রাতকানা, রক্ত স্বল্পতা, গা ফোলা বা কোয়াশিওরকর রোগে ভোগে। তবে ডিমের পরিপূর্ণ উপকার পাওয়ার জন্য আমাদের নিয়ম মেনে ডিম খাওয়া দরকার। উন্নত দেশগুলোতে সকাল বেলা নাস্তার সময় মানুষ একসাথে দুইটি ডিম খেয়ে থাকে। দুটো মাঝারী আকারের ডিম একত্রে খেলে মানব দেহের জন্য দৈনিক প্রয়োজনীয় ভিটামিন ডি এর ৮২%, ফোলিক এসিডের ৫০%, রাইবোফ্লাভিনের ২৫% এবং সেলেনিয়ামের ৪০% এই ডিম থেকে পূরণ করা সম্ভব।

ডিম ওজন নিয়ন্ত্রণ করে
অনেক সময় ক্ষুধা বেশি থাকার কারণে আমরা বেশি খাবার খেয়ে ফেলি। প্রধানত, বেশি খাওয়ার কারণেই ওজন বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ডিম আমাদের ক্ষুধা জমিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিম খেতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে সকালে একটি ডিম খাওয়ার মাধ্যমে শরীর থেকে দিনে প্রায় ৪০০ ক্যালরি কমানো সম্ভব । নিয়মিত সকালে ডিম খেলে মাসে প্রায় ৩ পাউন্ড ওজন কমানো সম্ভব। সকালে একটি ডিম আপনাকে সারা দিন কর্ম চঞ্চল রাখতে সাহায্য করবে। ডিম আমাদের দেহে ক্যালোরি সরবরাহের মাধ্যমে শক্তি দেয়।

ক্যানসার প্রতিরোধ ও শরীর গঠন করে ডিম
ক্যান্সার একটি মারাত্মক ব্যাধি। ডিমে থাকা ভিটামিন-ই আমাদের ত্বক এবং কোষের ফ্রি র‌্যাডিকেল ধ্বংস করে এবং ক্যানসার প্রতিরোধ করে। ছাড়াও নতুন কোষ গঠন করতে সাহায্য করে। বাড়ন্ত বয়সে কন্যা শিশুদের নিয়মিত ডিম খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। আমাদের শরীর গঠনের জন্য প্রোটিনের অন্যতম উপাদান যে নয়টি অত্যাবশ্যকিয় অ্যামাইনো এসিড দরকার তার সবকটিই থাকে ডিমে। সেজন্য ডিম খেলে সম্পূর্ণ প্রোটিনের চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। বয়সজনিত কারণে অনেক সময় মাংসপেশী শিথিল হয়ে যায়, ডিমের কুসুমে যে অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট লিউটিইন ও জিয়াজ্যানথিন) থাকে তা মাংসপেশীকে সুস্থ রাখে।

ডিম কোলিন ও জিংকের উৎস
আমাদের সার্বিক সুস্থতায় কোলিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেহে কোলিনের ঘাটতি হলে লিভারের সমস্যা হয়। ডিমে প্রায় ৩০০-৩৫০ মিলিয়াম কোলিন থাকে। তাই ডিম লিভার, কার্ডিওভাস্কুলার সিস্টেম, স্নায়ু এবং মস্তিষ্ক ভালো রাখে। আমাদের দেহে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ডিমের ভূমিকা রয়েছে। ডিমে থাকা জিংক আমাদের দেহে ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে। সর্দি, কার্শি, জ্বরসহ বিভিন্ন রকমের রোগ প্রতিরোধ করতে ডিম খাওয়া দরকার।

চোখের যতেœ ডিম
চোখের স্বাস্থ্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান হলো ডিম। ডিমের কুসুমে থাকে ভিটামিন এ, লিউটিইন, জিয়াজ্যানথিন এবং জিংক যেগুলে চোখের সুরক্ষায় খুবই প্রয়োজনীয় উপাদান। বিশেষকরে ভিটামিন এ হলো কর্ণিয়ার জন্য সেফগার্ড। কাজেই চোখের যতেœ দৈনিক ২টি করে ডিম খাওয়া প্রয়োজন। ডিমে বিদ্যমান অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট লিউটিইন ও জিয়াজ্যানথিন চোখের রোগ যেমন ক্রাটার্যাক্ট ও ম্যাকুলার ডিজেনারেশন প্রতিরোধ করে। তাছাড়া সিদ্ধ ডিম চোখের ছানি হওয়ার ঝুঁকি কমায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র (২০১৫) তথ্যমতে শতকরা ৮০ ভাগ অন্ধত্ব উপযুক্ত সময়ে চিকিৎসা ও সার্জারির মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। বাংলাদেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ অন্ধত্বই চোখের ছানির জন্য ঘটে থাকে। আর এর অপারেশন খরচও ততটা বেশি নয়। মানুষ অসচেতনতা এবং দারিদ্র্যের কারণে ছানি বয়ে বেড়ায় এবং এক পর্যায়ে এসে অবধারিতভাবে অন্ধত্ব বরণ করে।

চুল ও দাঁতের জন্য ডিম
চুল ও নখের মান উন্নত রাখতে নিয়মিত ডিম খান। কারণ ডিমের মধ্যে থাকা উচ্চ মাত্রায় সালফার চুল ও নখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। প্রতিদিন অত্যন্ত একটি ডিম খেলেই ৯ ধরণের রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়, শুধু তাই নয় ডিমের নানা পুষ্টি গুণাগুন শরীরকে রাখে সতেজ ও শক্তিতে ভরপুর। ডিমে থাকা ফসফরাস হাড় ও দাঁত মজবুত রাখে।

ডিম কোলেষ্টেরল বাড়ায় না
গবেষণায় দেখা গেছে ডিম খেলে দেহে কোলেস্টেরল বাড়ে না। দিনে একটা ডিম খেলে মানুষের দেহে লিপিড প্রাফাইলে কোনো প্রভাব পড়েনা। সিদ্ধ ডিমের কুসুম ক্ষতিকর কোলেস্টেরল কমিয়ে উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। সিদ্ধ ডিমের সাদা অংশ কোলেস্টরল কমাতে সাহায্য করে। ডিমে বিদ্যমান কোলিন স্নায়ু ও হৃদযন্ত্র সচল রাখতে সাহায্য করে। এটা মস্তিষ্কের মেমব্রেন ও পেশি সুগঠিত রাখতে সাহায্য করে এবং এটা স্নায়ু থেকে পেশিতে সংবেদন পৌঁছাতে সহায়তা করে।

অতিমারী ও ডায়াবেটিসনিয়ন্ত্রণে ডিম
সারা বিশ্বে ডিমের উৎপাদন বছরে প্রায় ৮০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। জাপানিরা প্রত্যেকে গড়ে প্রতি বছর ৩২০টি ডিম খেয়ে থাকে। আমাদের দেশে এই সংখ্যা সে তুলনায় অনেক কম, বর্তমানে এই দেশের মানুষ সারা বছরে ডিম খায় ১৩৭টি (ডিএলএস, ২০২৪-২৫), বাংলাদেশে বর্তমান সময়ে অন্য যেকোনো প্রাণিজ আমিষের চেয়ে ডিমের উপস্থিতি প্রতি ঘরে ঘরে। দামে কম, বেশি পুষ্টিকর হওয়ায় কোভিড ১৯ এর মতো মহামারির সময়ে প্রোটিন বুস্ট পাওয়ার প্রধান উপায়ই হচ্ছে ডিম খাওয়া। এছাড়া, ডিমের হাই কোয়ালিটি প্রোটিন বøাড সুগার নিয়ন্ত্রণ করে।

ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমার্স প্রতিরোধে ডিম
ডিমেনশিয়ার প্রাথমিক বিস্তার খুবই ধীরে হয়, এমনকি মাস কিংবা বছর ধরেও হতে পারে। ভুলে যাওয়ার কারণে রোগী হতাশা, নিদ্রাহীনতা ও অন্যান্য সমস্যায় ভোগে এবং আস্তে আস্তে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সাড়া বিশ্বে প্রায় ৫ কোটি মানুষ ডিমেনশিয়ায় ভুগছে। প্রতিবছর ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ডিমেনশিয়া সচেতনতা দিবস পালন করা হয়। ডিমেনশিয়া খুবই সাধারণ একটি রোগ। ইউ কে তে প্রতিদিন প্রায় ৬০০ জনের ডিমেনশিয়া দেখা দেয়। সেখানে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে ডিমেনশিয়ার হার বেশি। ৬৫ বছরের বেশি বয়স্কদের এই ঝুঁকি বেশি, তবে এটি তরুণদেরও প্রভাবিত করতে পারে। কিছু মানুষের ডিমেনশিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যেমন যাদের স্ট্রোক হয়েছে। যাদের রয়েছে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, উচ্চমাত্রার কোলেস্টেরল, বিষন্নতা ইত্যাদি। নিয়মিত মুরগির মাংস ও ডিম খাওয়ার ফলে ডিমনেশিয়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে ও আলঝেইমার্স রোগ হতেও মুক্তি পাওয়া যায় ।

ডিম বিষয়ে উন্নত দেশ ও জার্নালের তথ্য
চীনে প্রায় ৫ লাখ লোকের ওপর এক গবেষণা চালিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিদিন একটা করে ডিম খেলে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুকি কমতে পারে। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালের তথ্য মতে, দৈনিক একটি ডিম হার্টের ক্ষতি নয় উপকার করে। প্রক্রিয়াজাত মাংসের চেয়ে ডিম খাওয়া ভালো। আমেরিকা হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সপ্তাহে ৫-৬টি ডিম খেলেও উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, কোলেস্টেরলের কোনো ঝুঁকি প্রতিরোধের ক্ষেত্রে দুটো গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন হচ্ছে ওঋঘধরঢ়যধ২ধ এবং সধপৎড়ঢ়যধমব ঈঝঋ যার উপরে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় ও প্রথম প্রোটিনটি ক্যান্সার প্রতিরোধী এবং দ্বিতীয়টি ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুকে সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে । বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ওষুধের একটি ডোজ তৈরি করতে মাত্র তিনটি ডিমই যথেষ্ঠ।(এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিটেন, ২০১৯)।

উপসংহার
ডিম থেকে শারীরিক উপকার পেতে হলে স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে হবে। তবে একসময় যে বলা হতো বেশি ডিম খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর বিজ্ঞানীরা এখন সে মতবাদ পাল্টে ফেলেছেন। স্বাস্থ্যবান মেধাবী জনগোষ্ঠী গড়তে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ডিম খাওয়া পরিমান দ্বিগুন করতে হবে। ক্রমাগতভাবে ডিম খাওয়ার পরিমাণ বছর বছর বাড়লেও তা সন্তোষজনক নয়। উন্নত বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যবান মেধাবী জনগোষ্ঠী পড়তে পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে ডিম খাওয়ার পরিমান দ্বিগুণ করতে হবে। এবারের বিশ্ব ডিম দিবসে (১০ অক্টোবর ২০২৫) ডিম খাওয়ার সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি পালন করছে।

লেখক পরিচিতি : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও দপ্তর প্রধান : পোল্ট্রি রিসার্চ সেন্টার এবং প্রকল্প পরিচালক : পোল্ট্রি গবেষণা ও উন্নয়ন জোরদারকরণ প্রকল্প। ই-মেইল : sazdulkarim@yahoo.com

The short URL of the present article is: https://www.nirapadnews.com/uiq3
Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন