আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীদের চিকিৎসায় ত্বক প্রতিস্থাপন (Skin Grafting) একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া। যখন কোনো ব্যক্তি আগুনে গুরুতরভাবে পুড়ে যায়, তখন তাদের শরীরের ব্যাপক অংশের ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এই ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক শরীরকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে না এবং শরীরের তাপমাত্রা ও তরল ভারসাম্যে ব্যাঘাত ঘটায়। এমন পরিস্থিতিতে নতুন সুস্থ ত্বক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অংশ প্রতিস্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়ে।
স্কিন প্রতিস্থাপন কী?
স্কিন প্রতিস্থাপন হলো ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক সরিয়ে সুস্থ ত্বক স্থাপন করা। এই সুস্থ ত্বক সাধারণত রোগীর নিজের শরীর থেকেই নেওয়া হয়, যা অটোগ্রাফট (Autograft) নামে পরিচিত। কারণ, রোগীর নিজের ত্বক ব্যবহার করলে তা শরীর কর্তৃক প্রত্যাখ্যান হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। যদি রোগীর নিজের পর্যাপ্ত সুস্থ ত্বক না থাকে, তাহলে সাময়িকভাবে অন্যান্য উৎস থেকে ত্বক (যেমন cadaveric skin বা animal skin) ব্যবহার করা হয়, যা অ্যালোগ্রাফট (Allograft) বা জেনোগ্রাফট (Xenograft) নামে পরিচিত। তবে এগুলো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়, কারণ শরীর eventually এই ত্বক প্রত্যাখ্যান করে।
প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া
স্কিন প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া সাধারণত কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক অপসারণ: প্রথমে পুড়ে যাওয়া অংশের মৃত বা ক্ষতিগ্রস্ত ত্বক সাবধানে সরিয়ে ফেলা হয়। এটি সংক্রমণের ঝুঁকি কমায় এবং নতুন ত্বকের জন্য একটি পরিষ্কার ভিত্তি তৈরি করে।
ত্বক সংগ্রহ (Harvesting): এরপর রোগীর শরীরের কোনো সুস্থ অংশ থেকে, যেমন – উরু, পিঠ, বা নিতম্ব থেকে পাতলা করে ত্বক সংগ্রহ করা হয়। এই ত্বক সাধারণত একটি বিশেষ যন্ত্র, ডার্মাটোম (Dermatome) ব্যবহার করে কাটা হয়, যা অত্যন্ত পাতলা স্তরে ত্বক তুলতে সক্ষম।
ত্বকের প্রস্তুতি: সংগৃহীত ত্বককে কখনও কখনও ছোট ছোট টুকরা করে ছিদ্রযুক্ত করা হয় (mesh grafting), যাতে এটি বড় এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া যায় এবং এর নিচ থেকে তরল বেরিয়ে যেতে পারে। এটি সফলভাবে ত্বক স্থাপনে সহায়তা করে।
ত্বক স্থাপন: প্রস্তুতকৃত ত্বককে পুড়ে যাওয়া স্থানের উপর স্থাপন করা হয় এবং সেলাই বা স্টেপল করে আটকে দেওয়া হয়। এর উপর একটি ড্রেসিং (পটি) দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয় যাতে এটি সুরক্ষিত থাকে এবং রক্তনালী তৈরি হয়ে নতুন ত্বক স্থাপন হয়।
প্রতিস্থাপনের প্রকারভেদ
ত্বক প্রতিস্থাপনের দুটি প্রধান প্রকার রয়েছে:
স্প্লিট-থিকনেস গ্রাফট (Split-Thickness Graft): এই পদ্ধতিতে ত্বকের উপরের স্তর (এপিডার্মিস) এবং ডার্মিসের (ত্বকের মধ্যস্তর) আংশিক অংশ নেওয়া হয়। এটি সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি কারণ এটি বড় এলাকা কভার করতে পারে এবং যেখান থেকে ত্বক নেওয়া হয়েছে, সেই ‘ডোনার সাইট’ দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে।
ফুল-থিকনেস গ্রাফট (Full-Thickness Graft): এই পদ্ধতিতে ত্বকের এপিডার্মিস এবং ডার্মিস উভয়েরই সম্পূর্ণ অংশ নেওয়া হয়। এটি সাধারণত ছোট, গভীর পোড়ার জন্য বা এমন স্থানে ব্যবহার করা হয় যেখানে স্থিতিশীলতার প্রয়োজন, যেমন জয়েন্টের কাছে। এই গ্রাফটগুলো ডোনার সাইটে বেশি ক্ষত সৃষ্টি করে।
পুনরুদ্ধার ও জটিলতা
প্রতিস্থাপনের পর রোগীর সুস্থ হতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। নতুন ত্বককে শরীরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং রক্ত সরবরাহ তৈরি হতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগে। এই সময়ে সংক্রমণ, গ্রাফট প্রত্যাখ্যান, বা রক্ত জমাট বাঁধার মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। সফল প্রতিস্থাপনের পর ফিজিওথেরাপি এবং পুনর্বাসন অপরিহার্য, বিশেষ করে যদি পুড়ে যাওয়া স্থানটি জয়েন্টের কাছে হয়, যাতে কার্যকারিতা অক্ষুণ্ণ থাকে।
আগুনে পোড়া রোগীদের জন্য ত্বক প্রতিস্থাপন শুধু শারীরিক নিরাময়ের জন্যই নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি তাদের জীবন ফিরিয়ে দিতে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে সাহায্য করে।