আমরা সবাই কখনো না কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি—কথার মাঝপথে হঠাৎ কোনো শব্দ, নাম বা পরিচিত কিছু মনে আসতে চায়, কিন্তু আসছে না। মনে হয় যেন একেবারে ‘মুখের আগায়’ আছে, কিন্তু ধরা দিচ্ছে না।
এই বিরক্তিকর অথচ আকর্ষণীয় ঘটনাটিকে ইংরেজিতে বলা হয় Tip-of-the-Tongue Phenomenon। বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং এর পেছনে মস্তিষ্কের জটিল কার্যপ্রণালী খুঁজে পেয়েছেন।
যখন কোনো পরিচিত শব্দ আমাদের মনে পড়ছে না, তখন আমাদের মস্তিষ্কের একাধিক অংশ একযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঠিক যেন একদল লোক লাইব্রেরির ভেতরে হন্যে হয়ে নির্দিষ্ট একটি বই খুঁজছে। এই খোঁজার প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি অংশ হলো—অ্যান্টেরিয়র সিংগুলেট কর্টেক্স (মস্তিষ্কের সম্মুখভাগে সংকেত বিশ্লেষণকারী অংশ), প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স (বিবেচনা ও যাচাইয়ের অংশ) এবং ইনসুলা (ভাষার ধ্বনিগত অংশ শনাক্তকারী গভীর মস্তিষ্ক অঞ্চল)।
প্রথম দুই অংশ—অ্যান্টেরিয়র সিংগুলেট ও প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স—যৌথভাবে কাজ করে। একদিকে একাংশ সংকেত দেয়, ‘আমি শব্দটা চিনি, কিন্তু মনে পড়ছে না।’ অন্যদিকে অন্য অংশ যাচাই করে দেখছে, যে শব্দগুলো মনে পড়ছে সেগুলোর সঙ্গে কাঙ্ক্ষিত শব্দের মিল আছে কি না। ইনসুলা আমাদের মনে রাখা শব্দের ধ্বনি (শব্দের আওয়াজ বা গঠন) মনে করতে সাহায্য করে।
ফাংশনাল এমআরআই (এক ধরনের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ যন্ত্র) ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই অংশগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করে। যেন অনেকগুলো সহকর্মী একসঙ্গে মিলে জটিল কোনো সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করছে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের পরিস্থিতি বেশি দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বয়স্কদের ক্ষেত্রে ইনসুলা ও অ্যান্টেরিয়র সিংগুলেট অংশগুলোর কার্যক্ষমতা কমে যায়। ফলে শব্দ খুঁজে পাওয়ার কাজটা আগের মতো দক্ষতায় হয় না। একে তুলনা করা যায় বিশৃঙ্খল একটি লাইব্রেরির সঙ্গে—বইগুলো ঠিকমতো সাজানো নেই, ফলে খুঁজে পেতে সময় লাগে।
বয়স্কদের ক্ষেত্রে ইনসুলা অংশের কম সক্রিয়তা স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। এতে শব্দের ধ্বনিগত অংশ মনে করতে সমস্যা হয় এবং মুখের আগায় থাকা শব্দ বারবার আটকে যায়।
তবে বিষয়টি স্বাভাবিক এবং চিন্তার কিছু নেই। এটি মস্তিষ্কের জটিলতা এবং দক্ষতারই এক দৃষ্টান্ত। গবেষকরা বলেন, নিয়মিত মানসিক অনুশীলন, পড়ালেখা, সামাজিক যোগাযোগ ও শারীরিক চর্চা—এই সব কিছু মিলে তৈরি করে ‘কগনিটিভ রিজার্ভ’ (মস্তিষ্কের সঞ্চিত দক্ষতা), যা বয়স বাড়লেও আমাদের স্মৃতিশক্তিকে সচল রাখতে সাহায্য করে।
তাই, পরের বার কোনো শব্দ মনে না পড়লে ধৈর্য ধরুন। হয়তো কিছু সময় পরেই সেটা মনে পড়ে যাবে। কখনো কখনো একটু বিরতি নিয়েই ফিরে আসা ভালো। এসব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—আমাদের মস্তিষ্ক সত্যিই এক বিস্ময়কর যন্ত্র।