সদ্য অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে ‘আবকি বার ৪০০ পার (এবার চারশ পার)’ স্লোগানে নির্বাচনে তুমুল প্রচারণায় নেমেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি। লক্ষ্য ছিল ৪০০ আসন জিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদে অবস্থান নেওয়া। একাধিক বুথফেরত জরিপও বলেছিল, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ ৩৭০ থেকে ৪০০ আসনের বেশি পেয়ে তৃতীয়বার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে।
তবে চূড়ান্ত ফলে ৪০০ দূরের কথা, ৩০০ আসনও পায়নি বিজেপি নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স–এনডিএ। ভারতের নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফল অনুযায়ী, ৫৪৩টি আসনের মধ্যে এনডিএ পেয়েছে ২৯২টি।
হিন্দুস্তান টাইমস বলছে, মোদি এবার হ্যাটট্রিক করেছেন ঠিকই। কিন্তু পরিসংখ্যান অনুযায়ী তার ভোট কমেছে প্রায় ৯ শতাংশ। ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা শুরুর পরপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রেন্ডিংয়ে উঠে আসে একটি নাম ‘ধ্রুব রাঠী’। ফেসবুক, এক্সে ছড়িয়ে পড়েছে তার বিবৃতি ‘নেভার আন্ডারএস্টিমেট দ্য পাওয়ার অব অ্য কমন ম্যান।’ বলা হচ্ছে, ‘বিজেপি সাম্রাজ্যের ভীত নাড়িয়ে দিয়েছেন’ এই ওয়ান-ম্যান আর্মি।
ধ্রুব রাঠী কোনো রাজনীতিবিদ কিংবা সাংবাদিক নন; একজন ইউটিউবার। গত কয়েক মাসে নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপির কঠোর সমালোচনা করে একের পর এক ভিডিও তৈরি করেছেন তিনি। তার ভিডিও এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে আলজাজিরা, ফ্রান্স ২৪, দ্য ইকনোমিস্ট, টাইম ম্যাগাজিন, দ্য টেলিগ্রাফ, দ্য প্রিন্ট, দ্য ইকনোমিক টাইমসের মতো আন্তর্জাতিক পত্রিকায় শিরোনাম হয়েছেন তিনি।
একটি গবেষণার বরাতে আলজাজিরা জানিয়েছে, ভারতীয়রা মূলধারার নিউজ চ্যানেলের চাইতেও ইউটিউব ও হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া খবরে বিশ্বাস করে বেশি।
এই পটভূমিতে ইউটিউবে শক্তিশালী উপস্থিতি নিয়ে আসেন ধ্রুব রাঠী। ইউটিউবে তার ২১.৫ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবার রয়েছে, যা বিজেপির ইউটিউব চ্যানেলের প্রায় ৪ গুণ। নরেন্দ্র মোদির ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবার রয়েছে ২৩ মিলিয়ন ও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর সাবস্ক্রাইবার রয়েছে ৬ মিলিয়ন।
২৯ বছর বয়সী ধ্রুব রাঠী আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, একসময় নরেন্দ্র মোদির ভক্ত ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে রাজনীতিতে মোদির উত্থানে দুর্নীতি ও কালো টাকার বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার আশা দেখেছিলেন ধ্রুব। তিনি মোদিকে সমর্থক জানিয়েছিলেন এবং তার ক্ষমতায় যাওয়াকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। কিন্তু শিগগিরই কয়েকটি ঘটনায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন ধ্রুব।
তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আম আদমি পার্টি (এএপি) জাতীয়ভাবে বিরোধী দলে থাকলেও দিল্লিতে ক্ষমতায় ছিল। তারা একটি দুর্নীতিবিরোধী হেল্পলাইন চালু করেছিল। কিন্তু কেন্দ্রের মোদি সরকার ওই হেল্পলাইনের নিয়ন্ত্রণের জন্য এএপি রাজ্য সরকারের সঙ্গে তুমুল লড়াই শুরু করে।’
ধ্রুব বলেন, এ টি আমার জন্য খুব মর্মান্তিক মুহূর্ত ছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তিনি ভারত থেকে দুর্নীতি অপসারণ করতে আগ্রহী নন। মূলধারার টিভি চ্যানেল মোদি ও বিজেপির পক্ষে এক নাগাড়ে সমর্থন প্রদর্শনের পর তার হতাশা আরও বেড়ে যায়। সেই পটভূমিতে ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে ইউটিউবে তার প্রথম রাজনৈতিক মন্তব্য আপলোড করেছিলেন ধ্রুব। ভিডিওটি সম্পূর্ণরূপে তার ফোনে শ্যুট করা হয়েছিল।
গত আট বছরে তিনি তার প্রধান ইউটিউব চ্যানেলে প্রায় ৬৫০টি ভিডিও প্রকাশ করেছেন। তার অধিকাংশ ভিডিওর কেন্দ্রে থাকে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সরকারের সমালোচনা। স্ক্রিনে উপস্থিত হওয়া মাত্রই ব্যাকগ্রাউন্ডে অশুভ সাউন্ডট্র্যাক বাজতে শুরু করে। ভিডিও শুরুর আগে হাসিমুখে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘ভারত কি একনায়কত্বে পরিণত হচ্ছে?’
তিনি ব্যাখ্যা করেন, আপাতভাবে ভারতে গণতন্ত্র আছে বলেই মনে হয়; নাগরিকরা বিভিন্ন দলের মধ্যে থেকে নেতা বেছে নিতে পারেন এবং কাকে ভোট দেবেন তা নির্ধারণ করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা আরও জটিল। তিনি মোদি সরকারের দুর্নীতি, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানের অপব্যবহার এবং মোদি সরকারের সমালোচকদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেন।
তিন মাস আগে আপলোড করা ২৯ মিনিট ১১ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে রঙিন অ্যানিমেশন এবং ইনফোগ্রাফ দিয়ে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মিডিয়া এবং বিরোধীদের ওপর পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণ করার অভিযোগ তোলেন রাঠী। একের পর এক ভিডিওতে ধ্রুব রাঠী তুলে আনেন কৃষক আন্দোলন, লাদাখ ইস্যু, ইলেকটোরাল বন্ডের স্ক্যাম, ভারতের বেকার সমস্যাসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যু। তথ্য-উপাত্ত, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, আদালতের রায় সব তুলে ধরে তথ্যভিত্তিক ভিডিও তৈরি করেন তিনি।
ভোটের চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগে সর্বশেষ ভিডিওতে ধ্রুব রাঠী বলেন, আমি জানি যাদের বিরুদ্ধে আমি কথা বলছি এটি পাহাড়ের বিরুদ্ধে এক লোকের কথা বলার মতো। কিন্তু আমি মনে করেছি এটা আমার দায়িত্ব। যেখানে গণমাধ্যম ‘গদি মিডিয়া’ (ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে যে মিডিয়া) হয়ে গেছে। তাই কিছু হোক বা না হোক যেটা আমার করা উচিত, যেটা সঠিক কাজ সেটাই আমি করব।
রাঠী জানান, নির্বাচনের আগে রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি রাস্তায় প্রজেক্টর বসিয়ে তার ভিডিও জনসম্মুখে দেখিয়েছেন তার ভক্ত ও বিজেপি বিরোধী দলগুলো। এমনকি ভোট দেওয়ার পর গণমাধ্যমে কথা বলার সময় ধ্রুব রাঠীর ভিডিওর রেফারেন্স দিয়ে ভারতের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেছেন সাধারণ জনগণ।
ধ্রুব রাঠীর ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো- তিনি কথা বলেন একেবারে সাধারণ হিন্দি ভাষায়। তার ভিডিওতে ইংরেজি শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। তবে তিনি ইংরেজি সাবটাইটেল যুক্ত করেন। এতে করে বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও তার বিপুল সাবস্ক্রাইবার রয়েছে।
সর্বশেষ ভিডিওতে ধ্রুব রাঠী জানান, বিজেপির সমালোচনা করে ভিডিও করায় একটি সংঘবদ্ধ গ্রুপ তাকে কুকুর, তেলাপোকা ইত্যাদি গালি দিয়ে কন্টেন্ট বানিয়েছে। ‘অ্যান্টি ন্যাশনাল’, ‘পাকিস্তানের দালাল’, ‘চীন থেকে অর্থপ্রাপ্ত গুপ্তচর’ ইত্যাদি গুজবেও অসংখ্য ভিডিও ছড়ানো হয়েছে। এমনকি এইআই দিয়ে তার কণ্ঠ নকল করে গুজব ছড়ানো হয়েছে।
আল জাজিরাকে ধ্রুব রাঠী বলেন, আমাকে ও আমার স্ত্রী জুলিকে পাকিস্তানের দালাল বলে গুজব ছড়ানো হয়েছে। অনলাইনে আমার স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। আমাকে নিয়মিত প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আমি ভীত নই। কিন্তু আমি আমার অবস্থান বা আমার ভারতে থাকা পরিবারের অবস্থান কখনোই যাতে প্রকাশ না পায় এ বিষয়ে সতর্ক থাকি।
তিনি বলেন, দিনশেষে আমি যা করি তা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই। আমার চ্যানেল ভারতে নিষিদ্ধ হতে পারে। কিন্তু এখন কথা বলার সময়, তা না হলে অনেক দেরি হয়ে যাবে।