গত ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। এরপর থেকে ৩ বছর ৯ মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দীর্ঘ এই যুদ্ধে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দেশ ইউক্রেনে ব্যাপক জনসংখ্যা পতন হয়েছে। পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে, দেশটির অনেক হাসপাতাল যখন যুদ্ধে আহতদের অবিরাম স্রোত সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হোশচায় একটি প্রসূতি ওয়ার্ড ভয়াবহভাবে জনশূন্য অবস্থায় পড়ে আছে।
হোশচার ওই হাসপাতালে এ বছর রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত মাত্র ১৩৯টি জন্ম রেকর্ড করা হয়েছে, যা ২০২৪ সালে ছিল ১৬৪টি, এবং স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্যানুযায়ী, এক দশকেরও বেশি সময় আগে প্রতি বছর সেখানে ৪০০ জনেরও বেশি শিশুর জন্ম হতো।
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ইয়েভেন হেক্কেল তার অফিসে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “অনেক যুবক মারা গেছে। এসব যুবকেরই, সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, ইউক্রেনের পরবর্তী জিন পুল (জনসংখ্যা) পূরণ করার কথা ছিল।”
এভাবে ইউক্রেন যখন জনসংখ্যাগত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন কর্তৃপক্ষ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, ‘যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে, ভেঙে পড়া দেশটিকে পুনর্নির্মাণের জন্য কে থাকবে?’
দীর্ঘ প্রায় চার বছরের এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ নিহত এবং আহত হয়েছে। দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছে আরও লাখ লাখ মানুষ। ফলে জন্মহার মারাত্মকভাবে কমিয়ে গেছে।
প্রায় পাঁচ হাজার জনসংখ্যার একটি ছোট শহর হোশচা। শহরটি নিকটতম সীমান্ত থেকে কয়েকশ’ মাইল দূরে অবস্থিত। তবুও সেখানে জনসংখ্যা এখন সবচেয়ে বড় সংকট।
নিকটবর্তী সাদোভ গ্রামের একটি স্কুলে একসময় ২০০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থী ছিল। বর্তমানে শিক্ষার্থীর অভাবে তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
হোশচার টাউন কাউন্সিলের প্রধান মাইকোলা পাঞ্চুক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “দুই বছর আগে আমরা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ সেখানে মাত্র নয়জন শিশু ছিল।”
দেশ পুনর্গঠনে প্রয়োজন লাখ লাখ মানুষ
ইউক্রেনের জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির জনসংখ্যা ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে ইউক্রেনের জনসংখ্যা ছিল ৪২ মিলিয়ন, যা ইতোমধ্যেই ৩৬ মিলিয়নের নিচে নেমে গেছে। এর মধ্যে রাশিয়ার দখলকৃত এলাকায় রয়েছে কয়েক মিলিয়ন।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৫১ সালের মধ্যে এই সংখ্যা কমে ২৫ মিলিয়নে নেমে আসবে। ফলে জনসংখ্যা পতন ভয়াবহ রূপ নেবে।
সিআইএ ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুকের ২০২৪ সালের অনুমান অনুসারে, ইউক্রেনে বিশ্বের সর্বোচ্চ মৃত্যুহার এবং সর্বনিম্ন জন্মহার উভয়ই রয়েছে: প্রতিটি জন্মের জন্য প্রায় তিনটি মৃত্যু রেকর্ড হয় দেশটিতে।
ইউক্রেনের প্রতিটি অঞ্চলে জন্মের চেয়ে মৃত্যুহার বেশি
২০২৪ সালে ইউক্রেনের অঞ্চলগুলোতে প্রতিটি জন্মের বিপরীতে মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। সর্বত্রই হ্রাস পেয়েছে জন্ম হার। এই চিত্র সবচেয়ে বেশি ফ্রন্টলাইনের কাছাকাছি অঞ্চলে।
সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ইউক্রেনের গড় পুরুষ আয়ু যুদ্ধের আগে ৬৫.২ বছর থেকে ২০২৪ সালে ৫৭.৩ বছর হয়েছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ৭৪.৪ থেকে কমে ৭০.৯ হয়েছে।
বিশেষজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদরা বলছেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনর্গঠন ও যুদ্ধোত্তর ভবিষ্যতে মস্কো পুনরায় আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার জন্য লাখ লাখ মানুষের প্রয়োজন হবে। সেটি সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে আশঙ্কা করছেন অনেক ইউক্রেনীয়।
কিয়েভ সরকার গত বছর ২০৪০ সালের জন্য একটি জনসংখ্যা কৌশল রূপরেখা তৈরির সময় এই সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করে। নথিতে সতর্ক করা হয় যে, ইউক্রেন পরবর্তী দশকে ৪.৫ মিলিয়ন কর্মীর ঘাটতির মুখোমুখি হবে দেশটি। যেসব ক্ষেত্রে শ্রমিকের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে তার মধ্যে রয়েছে- নির্মাণ, প্রযুক্তি এবং প্রশাসনিক পরিষেবা।
কৌশলটিতে আরও অভিবাসন রোধ এবং বিদেশ থেকে ইউক্রেনীয়দের ফিরিয়ে আনার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আবাসন, অবকাঠামো এবং শিক্ষার উন্নতির কথাও বলা হয়েছে ওই কৌশলে। পাশাপাশি যদি চাকরি খালি থাকে, তবে অন্যান্য দেশ থেকে অভিবাসীদের আকর্ষণের কথাও বলা হয়েছে তাতে।
কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে ২০৪০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ৩৪ মিলিয়নে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে। তবে সতর্ক করে বলা হয়েছে, যদি বর্তমান নিম্নগামী প্রবণতা অব্যাহত থাকে, এই জনসংখ্যা কমে ২৯ মিলিয়নে নেমে যেতে পারে।
টাউন কাউন্সিলের বাসিন্দা পাঁচুক বলেন, ২০২২ সাল থেকে হোশচা এবং এর আশেপাশের জেলার ১৪১ জন নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সাল থেকে পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়া-সমর্থিত গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরও ১১ জন মারা গেছেন। অথচ এই অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা মাত্র ২৪ হাজার।
হোশচার বাকি দুটি স্কুলের একটির প্রধান শিক্ষিকা মারিয়ানা খ্রিপা বলেন, তার স্কুলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং স্কুল ছেড়ে প্রায় ১০ শতাংশই বিদেশে চলে যাচ্ছে, যাদের বেশিরভাগই ছেলে।
তিনি বলেন, “অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই দেশ থেকে বের করে দেন।
কেননা, কিয়েভ যুদ্ধের সময় ১৮ বছরের বেশি বয়সী পুরুষদের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যদিও প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আগস্টে বয়স বাড়িয়ে ২২ করেছেন।
২০০১ সালে ৪ কোটি ৮০ লাখেরও বেশি জনসংখ্যার ইউক্রেন, সংঘাতের অনেক আগেই জনসংখ্যাগত পতনের সম্মুখীন হয়েছে। কারণ, ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকট ও দুর্নীতি থেকে বাঁচতে দেশটির লাখ লাখ নাগরিক পূর্ব ইউরোপ থেকে পশ্চিমের দিকে পালাচ্ছিলেন।
রাশিয়া আক্রমণ করলে দেশত্যাগের প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। ফলে আরও লাখ লাখ মানুষ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
ইউক্রেনীয় থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর ইকোনমিক স্ট্র্যাটেজি মার্চ মাসে বলেছে, আক্রমণের পর থেকে চলে যাওয়া প্রায় ৫.২ মিলিয়ন ইউক্রেনীয় রাশিয়া, জার্মানি এবং পোল্যান্ডসহ প্রধানত ইউরোপীয় দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
সংস্থাটি ভবিষ্যদ্বাণী করে বলে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর এই লোকদের মধ্যে ১.৭ থেকে ২.৭ মিলিয়ন বিদেশেই থেকে যাবে এবং যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও লাখ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ- যাদের বর্তমানে ইউক্রেন ত্যাগ করার অনুমতি নেই- তারাও দেশে ছেড়ে তাদের সাথে যোগ দিতে পারে।
ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সেসের ডেমোগ্রাফি ইনস্টিটিউটের উপ-প্রধান ওলেক্সান্ডার গ্লাডুন বলেছেন, ২০২২ সাল থেকে শরণার্থীদের মধ্যে অল্পবয়সী নারীদের সংখ্যা অসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে জনসংখ্যা সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
২০২৪ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের পূর্বাভাস অনুসারে, ইউক্রেনের জনসংখ্যা ২১০০ সালের মধ্যে ৯ থেকে ২৩ মিলিয়নের মধ্যে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গ্রাম খালি, ঘরবাড়ি পরিত্যক্ত
হোশচার হাসপাতালের প্রসূতি ওয়ার্ডটি ২০২৩ সালে এক বছরে ১৭০টি জন্মের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়ার পর সরকারি তহবিল হারায়।
কাউন্সিলের প্রধান পাঞ্চুক বলেন, “একটি শিশু ১৫ মিনিট দেরিতে জন্মগ্রহণ করেছিল, তাই আমাদের জন্মসংখ্যা ১৬৯ ছিল।”
তিনি বলেন, টাউন কাউন্সিলের নিজস্ব বাজেট থেকে যা কিছু আছে তা দিয়েই এখন ওয়ার্ডটি টিকে আছে।
বর্তমানে যুদ্ধের নিশ্চিয়তা পরিবার শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মানুষের জন্য একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রসূতি ওয়ার্ডের প্রধান ইন্না আন্তোনিউক বলেন, প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারীর স্বামী সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ।
রুশ বাহিনী ধীরে ধীরে অগ্রসর হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব এবং দক্ষিণে যুদ্ধক্ষেত্রগুলো ধীরে ধীরে সরে গেলেও, মস্কো ইউক্রেনজুড়ে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন আক্রমণ বাড়িয়েছে, যার ফলে বেসামরিক, জ্বালানি এবং সামরিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
পাঞ্চুক বলেন, হোশচার জনসংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে হ্রাস পাচ্ছে না, কারণ আশেপাশের গ্রামগুলো খালি হয়ে যাচ্ছে এবং স্থানীয় স্কুল, ক্লিনিক এবং অন্যান্য পরিষেবা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের বাসিন্দারা শহরে চলে যাচ্ছে।
হোশচা থেকে ১০ কিলোমিটার (৬ মাইল) এরও কম দূরে দুলিবি গ্রামের রাস্তায় বেশ কয়েকটি বাড়ি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
স্থানীয় বাসিন্দা ওকসানা ফরমানচুক বলেন, এই ছোট্ট গ্রামে যেখানে ২০০ জনেরও কম বাসিন্দা রয়ে গেছে, সেখানেও নয়জন পুরুষকে যুদ্ধের জন্য একত্রিত করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে তার স্বামীও ছিলেন, যিনি জুলাই মাস থেকে কর্মক্ষেত্রে নিখোঁজ ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, তিনি ভয় পেয়েছিলেন যে তার দুই প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকেও সেনাবাহিনীতে পাঠানো হবে। যদি তাদেরও নিয়ে যাওয়া হয়? তাদের ছাড়া আমি কী করতাম?
‘এখানে গড়ে তোলার মতো কিছুই নেই’
হোশচার হাই স্ট্রিটে একটি ভ্যানে কফি বিক্রি করছিলেন ২১ বছর বয়সী আনাস্তাসিয়া ইউশচুক। তিনি বলেন, তার অনেক বন্ধু সন্তান ধারণে দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি বলেন, যদিও তিনি একদিন পরিবার শুরু করার আশা করেছিলেন, তবে আগামী কয়েক বছরে তা করার কোনও ইচ্ছা তার নেই। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখানে কোনও স্থিতিশীলতা নেই, গড়ে তোলার মতো কিছুই নেই।
তিনি বলেন, যুদ্ধের কারণে বিদ্যমান আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে, যেমন ভাড়া বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়। এখন তরুণদের জন্য বাড়ি কেনা খুব কঠিন। আমাদের এবং আমার সঙ্গী উভয়কেই আর্থিকভাবে স্থিতিশীল থাকতে হবে এবং দেশের পরিস্থিতি প্রতি মাসে বা দুই মাসে পরিবর্তিত হচ্ছে, তাই পরিকল্পনা করা কঠিন।
