ইতালির মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ সিসিলিকে সরাসরি যুক্ত করতে ১৫.৬ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করছে দেশটির সরকার। এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে দ্বীপটির বাসিন্দারা।
সিসিলির মেসিনা শহরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ এই বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন। সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১ হাজার ৩৫০ কোটি ইউরো (১ হাজার ৫৭০ কোটি ডলার) মূল্যের একটি অবকাঠামো প্রকল্পের আওতায় সেতুটি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তবে আলোচিত এই সেতুটির নির্মাণকাজ শুরুর জন্য দেশটির অডিট আদালতের অনুমোদন লাগবে।
মনে করা হচ্ছে, আগামী সেপ্টেম্বরের শেষ বা অক্টোবরের শুরুতে প্রাথমিক কাজ শুরু হতে পারে। পুরোদমে নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। ২০৩২ থেকে ২০৩৩ সালের মধ্যে প্রকল্পটির নির্মাণ শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
তবে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রস্তাবিত ‘স্টেট অব মেসিনা ব্রিজ’ নামক প্রকল্পটির বিরোধিতা করছেন। তাদের আশঙ্কা, সেতুটি নির্মাণ হলে পরিবেশের ক্ষতি হবে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি বাড়বে এবং মাফিয়ারা প্রভাব বিস্তার করবে।
তবে ইতালির পরিবহনমন্ত্রী মাত্তেও সালভিনি এই পরিকল্পনাকে ‘পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প’ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রকল্প বছরে ১ লাখ ২০ হাজারের মতো কর্মসংস্থান তৈরি করবে এবং তা দক্ষিণ ইতালির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে সহায়ক হবে। তা ছাড়া প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়নে কয়েক শ কোটি ইউরো বিনিয়োগ করা হবে।
তবে সমালোচকেরা তার এ বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। কারণ, সেতু নির্মাণের জন্য প্রায় ৫০০ পরিবারকে উচ্ছেদ করতে হবে। তবে সালভিনি বলেন, এসব পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
মেসিনা প্রণালির ওপর সেতুটি নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে কয়েক দশক ধরেই বিতর্ক চলছিলো। চলতি সপ্তাহে ইতালির সরকারের কৌশলগত সরকারি বিনিয়োগ–সংক্রান্ত তদারকি কমিটি প্রকল্পটি অনুমোদন করে।
মেসিনার ৭৫ বছর বয়সী বাসিন্দা ফ্রান্সেস্কোর বাড়িটি সেতুটির জন্য পরিকল্পিত ৩৯৯ মিটার (৪৪০ গজ) উঁচু একটি ল্যান্ড টাওয়ারের কাছে অবস্থিত। তিনি বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, সরকার আমাকে আমার বাড়ির তিন গুণ টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করতে পারে, কিন্তু আমার তাতে আগ্রহ নেই। আমার কাছে প্রাকৃতিক দৃশ্য গুরুত্বপূর্ণ। সরকার মেসিনা প্রণালি স্পর্শ করতে পারবে না।
ন্যাটো ইতালিকে প্রতিরক্ষা বাজেট জিডিপির ৫ শতাংশে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছে। ইতালির সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা সেতুটিকে প্রতিরক্ষার সঙ্গে সম্পর্কিত করে দেখাবে। ঝুলন্ত সেতুর এ প্রকল্পটি তাদের ন্যাটোর বেঁধে দেওয়া সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে।
এ প্রসঙ্গে ইতালি সরকারের যুক্তি হলো, এই সেতু নির্মাণের মধ্য দিয়ে দ্রুত সেনা ও সরঞ্জাম মোতায়েনের জন্য একটি কৌশলগত করিডর তৈরি হবে। তাই এটিকে ‘নিরাপত্তা জোরদারকারী অবকাঠামো’ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো এরই মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ জমা দিয়েছে। তাদের আশঙ্কা, প্রকল্পটি পরিযায়ী পাখিদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
তবে ইতালির প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেছেন, অন্যান্য বড় আকারের অবকাঠামো প্রকল্পের মতোই এই প্রকল্পটিও মাফিয়াবিরোধী আইন মেনে বাস্তবায়িত হবে।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত এই ঝুলন্ত সেতুটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার (২ দশমিক ৩ মাইল)। এর মধ্যে ঝুলন্ত অংশের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার (২ মাইলের বেশি)। নির্মিত হলে এটি হবে বিশ্বের একক স্প্যান বা সবচেয়ে দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু, যার দুই প্রান্তের মধ্যবর্তী স্থানে কোনো স্তম্ভ (পিলার) থাকবে না।
তাছাড়া, সেতুটি নির্মিত হলে সিসিলি ও ইতালির মূল ভূখণ্ডের মধ্যে আসা-যাওয়ার সময় অনেক কমে যাবে। পরিবহন মন্ত্রী সালভিনির তথ্যমতে, বর্তমানে ফেরিতে করে প্রণালিটি পার হতে সময় লাগে প্রায় ১০০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। আর সেতু হয়ে গেলে গাড়িতে করে পার হতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। সেতুটি নির্মাণ হয়ে গেলে ট্রেনের মাধ্যমে যাত্রার সময়ও ২ ঘণ্টা ৫০ মিনিট কমবে।