ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের বাহারাইচ জেলার ঘন জঙ্গলে ঘেরা গেরুয়া নদীতে একটি ছোট নৌকাডুবে নিখোঁজ অন্তত ১০ যাত্রী। বুধবার ভোরের দিকে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
সরকারি সূত্রে এখনো পর্যন্ত নিশ্চিত মৃত্যুর খবর না পাওয়া গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, নৌকাটিতে ৩০ জনেরও বেশি যাত্রী ছিলেন এবং তাদের অধিকাংশ দিনমজুর ও গ্রামীণ নারী। প্রবল স্রোত ও নৌকার অতিরিক্ত ভার বহনের কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রাথমিক অনুমান।
স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, সকালে কাজের খোঁজে পাশের গ্রাম মহসিনপুরের দিকে যাচ্ছিলেন কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ। নৌকাটি ছিল কাঠের তৈরি এবং দীর্ঘদিন ধরে মেরামতহীন অবস্থায় চলছিল। ভোরের আলো ফোটার আগেই নদী পার হওয়ার সময় হঠাৎ প্রবল বাতাসে নৌকাটি উলটে যায়।
স্থানীয়দের ভাষ্য, প্রশাসনের পক্ষ থেকে উদ্ধার সরঞ্জাম বা পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা আগে থেকে নেওয়া হয়নি। দুর্ঘটনার পর উদ্ধারকাজ শুরু হলেও তা ছিল অত্যন্ত বিলম্বিত।
দুর্ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়তেই এলাকায় শুরু হয় চরম বিশৃঙ্খলা। নিহতদের স্বজনরা নদীর দুই তীরে জড়ো হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ক্ষোভে ফেটে পড়ে গ্রামবাসীরা অভিযোগ তোলেন, প্রতিদিন এই নৌকা দিয়ে শতাধিক মানুষ পারাপার হয়, অথচ প্রশাসনের কোনো নজর নেই। নদীতে কোনো সেতু নেই, জীবনের ঝুঁকি নিয়েই সবাই যাতায়াত করে।
এক স্থানীয় যুবক বলেন, এখানে জীবনের মূল্য নেই, গরিব মানুষ মরলে কারও কিছু আসে যায় না।
স্থানীয় দমকল বাহিনী ও দুর্যোগ মোকাবিলা দল ঘটনাস্থলে পৌঁছালেও উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। নদীর স্রোত ছিল অত্যন্ত প্রবল, আর ঘন জঙ্গল ও কর্দমাক্ত তীরবর্তী অঞ্চলের কারণে নৌকা চালানোও ছিল কঠিন। প্রায় তিন ঘণ্টা পর প্রথম লাশটি উদ্ধার হয়, যা দেখে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। এখনো পর্যন্ত অন্তত ১০ জন নিখোঁজ রয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, তবে সরকারি পরিসংখ্যানে তা পাঁচে নামিয়ে আনা হয়েছে।
ঘটনার পর প্রশাসনের গাফিলতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে স্থানীয় নাগরিক সমাজ। তারা বলছেন, উত্তরপ্রদেশ সরকারের উন্নয়ন দাবি আসলে কাগুজে কথামাত্র। গ্রামীণ এলাকার মানুষ এখনো যেভাবে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিনের যাতায়াত করেন, তা থেকে স্পষ্ট—পরিকাঠামোগত উন্নয়নের নামে প্রকৃত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। রাষ্ট্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, উদ্ধার সরঞ্জামের ঘাটতি এবং দুর্ঘটনার পরের শোচনীয় বিশৃঙ্খলা—সবই প্রতিফলিত করছে এক ভয়াবহ প্রশাসনিক অবহেলার চিত্র।
এমন এক সময়ে যখন উত্তরপ্রদেশ সরকার নিজেদের রাজ্যকে নতুন ভারতের উন্নয়নের মডেল বলে প্রচার করছে, তখন বাহারাইচের মতো দুর্গম অঞ্চলে মানুষ আজও নৌকায় প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হতে বাধ্য হচ্ছেন—এটাই বাস্তব। দুর্ঘটনার পর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ টুইটারে শোক প্রকাশ করেছেন এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু স্থানীয়দের বক্তব্য, এই ধরনের প্রতিশ্রুতি আগেও বহুবার দেওয়া হয়েছে—বাস্তবে কোনো ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন মেলেনি।
ঘটনার পর জেলা প্রশাসক অমিত কিশোর জানান, দুর্ঘটনার খবর পাওয়া মাত্রই উদ্ধারকাজ শুরু হয়েছে। নিখোঁজদের সন্ধান চলছে, তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই বিবৃতি স্থানীয়দের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দেয়। গ্রামবাসীদের মতে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রতি বছর বন্যার সময় আশ্বাস দেন, কিন্তু নদীর ওপর একটি সেতু নির্মাণের কোনো উদ্যোগই দেখা যায় না। ফলে প্রতিবারই গরিব মানুষের জীবন যায়, তারপর কিছুদিন হৈচৈ হয়, তারপর সব ভুলে যাওয়া হয়।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, কিন্তু তার উপস্থিতিতেও জনতার ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। বহু মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, কেন গ্রামীণ এলাকায় এখনো নিরাপদ যাতায়াতের কোনও ব্যবস্থা নেই, কেন প্রশাসন প্রতি বছর একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলেও শিক্ষা নিচ্ছে না। উত্তরপ্রদেশের দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে সরকারি নজরদারির অভাব নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও।
উল্লেখ্য, বাহারাইচ জেলা ভারত-নেপাল সীমান্তবর্তী এক জঙ্গলঘেরা অঞ্চল, যেখানে যোগাযোগব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল। প্রাকৃতিক বিপর্যয় বা দুর্ঘটনা ঘটলেই উদ্ধারকারী দল পৌঁছাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগে। স্থানীয়রা দাবি করছেন, প্রশাসনের এই অবহেলা পরিকল্পিত, কারণ এই এলাকার মানুষ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তাদের কণ্ঠে কেউ সাড়া দেয় না, তাই প্রতিবারই এমন দুর্ঘটনার পর সব কিছু আগের মতোই চলতে থাকে।
