থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আলোচিত ও বিতর্কিত সিনাওয়াত্রা পরিবার আবারও চরম সঙ্কটে পড়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) দেশটির সুপ্রিম কোর্ট এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে।
দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মামলায় ২০২৩ সালে দেওয়া সাজা তিনি যথাযথভাবে ভোগ করেননি—এই অভিযোগে এ রায় ঘোষণা করা হয়। হাসপাতাল থেকে তাকে সরাসরি কারাগারে নেওয়া হবে।
এই ঘটনার মধ্যেই তার মেয়ে পেতংটার্ন সিনাওয়াত্রা প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। অন্যদিকে বোন ইংলাক সিনাওয়াত্রা বহু বছর ধরে নির্বাসনে আছেন। ফলে প্রায় দুই দশক ধরে থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তারকারী এই পরিবার নতুন করে বড় ধরনের অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
থাকসিন সিনাওয়াত্রা: পিতৃতুল্য চরিত্র ও রাজনৈতিক উত্থান
পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও থাকসিন পরবর্তীতে টেলিকম ব্যবসায় বিপুল সম্পদ অর্জন করেন এবং শিন করপোরেশন প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর রাজনীতিতে প্রবেশ করে ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচি তাকে দেশের শ্রমজীবী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে জনপ্রিয় করে তোলে।
তবে দুর্নীতি ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের অভিযোগে ২০০৬ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। ২০০৮ সালে দেশ ছেড়ে দীর্ঘ নির্বাসনে চলে যান এবং মূলত দুবাইয়ে অবস্থান করেন। যদিও বিদেশে থেকেও তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং মিত্র দলগুলোর মাধ্যমে প্রভাব বজায় রাখেন। ১৭ বছর পর, ২০২৩ সালের আগস্টে দেশে ফেরেন তিনি। কিন্তু চলতি বছর আদালত তার বিরুদ্ধে ১২ বছরের সাজা বহাল রাখে।
ইংলাক সিনাওয়াত্রা: প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী থেকে নির্বাসন
থাকসিনের বোন ইংলাক ২০১১ সালে থাইল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন। তবে চাল ভর্তুকি কর্মসূচি নিয়ে সমালোচনার মুখে ২০১৪ সালে সাংবিধানিক আদালত তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ২০১৭ সালে সম্ভাব্য কারাদণ্ড এড়াতে তিনি দেশ ছেড়ে নির্বাসনে চলে যান।
ধারণা করা হয়, তিনি বর্তমানে দুবাইয়ে আছেন এবং পরিবারের সমর্থকদের কাছে প্রতীকী চরিত্র হিসেবে রয়ে গেছেন।
পেতংটার্ন সিনাওয়াত্রা: দ্রুত উত্থান, হঠাৎ পতন
পিতার দেশে ফেরার পর সিনাওয়াত্রা পরিবারের রাজনীতিতে নতুন নেতৃত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন পেতংটার্ন। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ২০২৪ সালের আগস্টে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন—দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী ও দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু মাত্র এক বছরের মধ্যে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বড় ধাক্কা খায়। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে সাংবিধানিক আদালত তাকে বরখাস্ত করে।
অভিযোগ ওঠে, সীমান্ত উত্তেজনার সময় তিনি কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতকে ফোনে ‘চাচা’ সম্বোধন করেছিলেন, যা নৈতিক আচরণবিধি লঙ্ঘনের শামিল। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে আদালতের রায় ঘোষণা হবে, যা পদচ্যুতি বহাল রাখা বা আইনি শাস্তির দিকে যেতে পারে।
জনপ্রিয়তা বনাম রক্ষণশীল গোষ্ঠীর বিরোধিতা
সিনাওয়াত্রা পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই থাইল্যান্ডের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল ইসান অঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দৃঢ় সমর্থন পেয়েছে। তাদের নীতি ও কর্মসূচি অভিজাত ও সেনা-সমর্থিত রক্ষণশীল গোষ্ঠীর বিপরীতে অবস্থান করেছে।
২০০৬ ও ২০১৪ সালের সামরিক অভ্যুত্থানসহ একের পর এক আইনি পদক্ষেপের মুখেও পরিবারটির জনপ্রিয়তা টিকে আছে। সমর্থকদের মতে, এসব পদক্ষেপ ছিল তাদের রাজনৈতিক প্রভাব ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা। অন্যদিকে সমালোচকেরা পরিবারটিকে দুর্নীতি, নীতির বেপরোয়া ব্যবহার ও বংশানুক্রমিক রাজনীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করে আসছে।
অনিশ্চয়তার দোরগোড়ায় সিনাওয়াত্রারা
বর্তমানে থাকসিন কারাগারে, ইংলাক নির্বাসনে, আর পেতংটার্ন বরখাস্ত অবস্থায় আছেন। এই পরিস্থিতিতে সিনাওয়াত্রা পরিবারের ভবিষ্যৎ নিয়ে জোর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যদিও তাদের টিকে থাকা জনপ্রিয়তা ও দৃঢ় সমর্থন দেখাচ্ছে—রাজনৈতিক সঙ্কট যত গভীরই হোক না কেন, থাইল্যান্ডের অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই পরিবারকে এখনও উপেক্ষা করা সম্ভব নয়।