গাজার খান ইউনিসের নাসের হাসপাতালে তীব্র অপুষ্টির শিকার শিশুদের জন্য যে ওয়ার্ড, সেখানে গোলাপি রঙের দেয়ালে কার্টুন আঁকা। সেই ছবিতে শিশুরা দৌড়াচ্ছে, হাসছে এবং ফুল ও বেলুন নিয়ে খেলছে।
ছবিগুলোর নিচে গাজার কয়েকজন ফিলিস্তিনি মা তাঁদের সন্তানদের দিকে উদ্বেগের চোখে তাকিয়ে আছেন। শিশুগুলো হাসপাতালের বিছানায় নিথর হয়ে পড়ে আছে। ভীষণ ক্ষুধা আর ক্লান্তিতে বেশির ভাগ শিশু কাঁদতে পর্যন্ত পারছে না।
বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে চিকিৎসকেরা বলেন, সবচেয়ে বেশি অপুষ্টিতে ভোগা রোগীদের যেখানে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে সাধারণত এমন নীরবতাই দেখতে পাওয়া যায়। এটা শরীর ক্রমশ নিস্তেজ ও অসাড় হয়ে পড়ার লক্ষণ।
ওই স্থানে থাকা এক শিশুর মা জেইনা রাদওয়ান বলেন, ‘সে সব সময় এমন অবসন্ন হয়ে থাকে, এভাবেই শুয়ে থাকে…আপনি তার কোনো সাড়া পাবেন না।’ জেইনা তাঁর ১০ মাস বয়সী মেয়ে মারিয়া সুহাইব রাদওয়ানকে নিয়ে এ কথা বলছিলেন।
এই মা বলেন, তিনি তাঁর মেয়ের জন্য দুধ বা পর্যাপ্ত খাবার জোগাড় করতে পারেননি। সে বুকের দুধও পাচ্ছে না। কারণ, জেইনা নিজেও দিনে মাত্র একবেলা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছেন। তিনি বলেন, ‘পুষ্টি না পেলে আমার মেয়ে আর আমি—কেউই বাঁচব না।’
গত সপ্তাহে রয়টার্সের সাংবাদিকেরা নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে পাঁচ দিন কাটিয়েছেন। গাজায় ভীষণ রকমের অনাহারে থাকা শিশুদের যে চারটি মাত্র চিকিৎসাকেন্দ্রে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর একটি নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্স। রয়টার্সের সাংবাদিকেরা সেখানে থাকার সময় তীব্র অপুষ্টিতে আক্রান্ত ৫৩ শিশুকে ভর্তি করা হয়।
২০২৩ সালের অক্টোবরে ইসরায়েল হামলা শুরু করার পর গাজার খাদ্যমজুত দ্রুত ফুরিয়ে যায়। এ বছর মার্চ থেকে ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে দেয়।
গত মে মাসে অবরোধ খানিকটা শিথিল করা হলেও ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হাতে ত্রাণ পৌঁছানো বন্ধের অজুহাতে ইসরায়েল নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে রেখেছে।
গাজায় ত্রাণ প্রবেশ করার বিষয়ে জানতে রয়টার্স থেকে ইসরায়েলি সামরিক সহায়তা সমন্বয় সংস্থার (সিওজিএটি) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। সিওজিএটি দাবি করেছে, ইসরায়েল গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশে কোনো বাধা দেয় না। তবে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো গাজার ভেতরে ত্রাণ সংগ্রহে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, তারা ত্রাণসংস্থা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে নিয়মিত চিকিৎসাসেবা সরবরাহে সহায়তা করছে এবং সংস্থাগুলোর সঙ্গে মিলে গাজার হাসপাতালগুলোর প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
অনাহারে মৃত্যু দ্রুত বাড়ছে
গাজায় গত জুন থেকে খাদ্যসংকট ও অনাহার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সেখানে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এরই মধ্যে তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা কঙ্কালসার শিশুদের ছবি বিশ্বজুড়ে মানুষের মনে গভীর আলোড়ন তুলেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, অপুষ্টিজনিত কারণে এখন পর্যন্ত ১৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৮৯টি শিশু। বেশির ভাগ মৃত্যু হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহে।
আন্তর্জাতিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষণকারী একটি সংস্থা গত মঙ্গলবার বলেছে, গাজায় দুর্ভিক্ষ ক্রমেই বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
এদিকে ইসরায়েল দাবি করছে, গাজাকে অনাহারে রাখার কোনো উদ্দেশ্য তাদের নেই। এ সপ্তাহে তারা আরও বেশি ত্রাণ প্রবেশের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে। ত্রাণ প্রবেশ ও বিতরণে সহায়তার জন্য কোথাও কোথাও যুদ্ধ স্থগিত করা, আকাশ থেকে ত্রাণ ফেলা এবং ত্রাণ প্রবেশের পথ আরও নিরাপদ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ বলেছে, দুর্ভিক্ষ রোধ ও স্বাস্থ্যসংকট এড়াতে প্রচুর পরিমাণে ত্রাণসহায়তা প্রয়োজন।
নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সের শিশু ও মাতৃত্ব বিভাগের প্রধান চিকিৎসক আহমেদ আল-ফররা বলেন, ‘শিশুদের জন্য দুধ প্রয়োজন। আমাদের চিকিৎসাসামগ্রী প্রয়োজন। আমাদের কিছু খাবারও প্রয়োজন, বিশেষ করে পুষ্টি বিভাগের জন্য উপযোগী খাবার। হাসপাতালের জন্য আমাদের সবকিছু প্রয়োজন।’
কিন্তু ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, গাজায় অপুষ্টির কারণে যেসব মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই আগে থেকে নানা রোগে ভুগছিলেন।
দুর্ভিক্ষ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো ক্ষুধা ও অনাহারসংক্রান্ত সংকটের প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণত এমন ঘটনা ঘটে।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের সহযোগী অধ্যাপক মার্কো কেরাক বলেন, ‘(ক্ষুধাজনিত সংকটময় পরিস্থিতিতে) আগে থেকে নানা জটিল রোগে ভোগা শিশুরা আরও বেশি সংকটে পড়ে যায়। শুরুতে তারাই প্রভাবিত হয়।’
তবে এখন প্রচণ্ড অপুষ্টি নিয়ে নাসের মেডিকেল কমপ্লেক্সে যেসব শিশু ভর্তি হচ্ছে, তাদের কেউ আগে থেকে অসুস্থ ছিল না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক ফাররা। উদাহরণ টানতে গিয়ে তিনি তিন মাস বয়সী শিশু ওয়াতিন আবু আমুনাহর কথা বলেন। স্বাভাবিক ওজন নিয়ে শিশুটির জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এখন তিন মাস বয়সে এসে তার ওজন জন্মের সময়ের চেয়ে ১০০ গ্রাম কম।
চিকিৎসক ফাররা বলেন, ‘গত তিন মাসে শিশুটির ওজন এক গ্রামও বাড়েনি; বরং সে ওজন হারিয়েছে। তার শরীরে কোনো মাংসপেশি নেই। শুধু হাড়ের ওপর চামড়া; যা ইঙ্গিত করে, শিশুটি তীব্র অপুষ্টির পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। শিশুটির মুখ দেখলেই বোঝা যায়, তার গালে কোনো চর্বি নেই।’
শিশুটির মা ইয়াসমিন আবু সুলতান তাঁর সন্তানের হাত-পা দেখিয়ে বলেন, ওর বাহু বৃদ্ধাঙ্গুলির মতো দেখতে। তিনি রয়টার্সের সাংবাদিকদের আরও বলেন, ‘আপনারা দেখতে পাচ্ছেন? এই ওর পা…ওর হাতের দিকে তাকান।’
গাজায় চলতি জুলাই মাসের প্রথম দুসপ্তাহে ৫ বছরের কম বয়সী পাঁচ হাজারের বেশি শিশু অপুষ্টির কারণে বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে। এসব শিশুর ১৮ শতাংশ তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
ডব্লিউএইচও বলেছে, জুনে অপুষ্টির শিকার হয়ে গাজায় চিকিৎসা গ্রহণ করা শিশুদের সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৬ হাজার। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটাই ছিল এক মাসে অপুষ্টিতে ভোগা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিশুর চিকিৎসা গ্রহণের ঘটনা। সংস্থাটি বলছে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।
নাসের হাসপাতালে থাকা বেশ কয়েকজন শিশুর মতো ওয়াতিনও বারবার জ্বর ও ডায়রিয়ায় ভুগছে। অপুষ্টির শিকার শিশুরা এসব রোগে আক্রান্ত হলে তাদের জীবন আরও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কারণ, এসব অসুস্থতা তাদের অপুষ্টি অবস্থা আরও গুরুতর করে তোলে।
ওয়াতিনের মা বলেন, ‘যদি ওর অবস্থা এমনই থাকে, তবে আমি ওকে হারাতে চলেছি।’
ওয়াতিন এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। সেখানে তার মা তাকে বোতলে থাকা দুধ একটু একটু করে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন।
রয়টার্সের প্রতিনিধিরা এ হাসপাতালে আরও কয়েকটি অপুষ্টির শিকার শিশুকে দেখেছেন। এই শিশুদের ওজন হাসপাতালে ভর্তি ও চিকিৎসার পর কিছুটা বেড়েছে। হাসপাতাল থেকে তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদের কিছু ফর্মুলা দুধ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু পাঁচ মাসের শিশু জয়নাব আবু হালিবের মতো শিশুরা হাসপাতালে এসেও বাঁচতে পারেনি। তীব্র অপুষ্টিতে মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়া তার ছোট্ট দেহ সংক্রমণের ধাক্কা সামলাতে পারেনি। রক্তে ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণে গত শনিবার তার মৃত্যু হয়। তার বাবা-মা ছোট্ট দেহটি সাদা কাফনে মুড়িয়ে হাসপাতাল থেকে কবর দিতে নিয়ে গেছেন।