English

28 C
Dhaka
মঙ্গলবার, এপ্রিল ১৬, ২০২৪
- Advertisement -

গামোছা ও গামছা নিয়ে আসামে তুলকালাম

- Advertisements -

আসামে নবগঠিত একটি সাহিত্য সংগঠন ‘বাংলা সাহিত্য সভা’ ২৫ মার্চ প্রথমবারের মতো গুয়াহাটিতে রাজ্য সম্মেলন আয়োজন করে। আয়োজকরা তাদের অতিথি এবং প্রতিনিধিদের একটি বিশেষ ধরনের কাপড়ের টুকরো দিয়ে সংবর্ধনা দেন। এটি তৈরি করা হয়েছে আসামি ফুলাম গামোছা এবং বাঙালি গামছা মাঝামাঝি কেটে একসঙ্গে জোড়া লাগিয়ে।

ফুলাম গামোছা হাতে বোনা লাল ও সাদা তোয়ালে­। এটিকে আসামের সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

অনুষ্ঠানটির ছবি ছড়িয়ে পড়ার পর তুলকালাম শুরু হয়েছে। অনেকে এই উদ্যোগকে আসামি সমাজের জন্য অপমান হিসেবে উল্লেখ করছেন। সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে আসামের সংস্কৃতিমন্ত্রী কুশপুতুল দাহ করা হয়েছে। রাজপথে বিক্ষোভের পাশাপাশি হাই ভোল্টেজ টেলিভিশন বিতর্ক এবং সোশাল মিডিয়ায় জ্বালাময়ী মন্তব্যের ছড়াছড়ি। রাজ্যজুড়ে বাংলা সাহিত্য সভার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে।

প্রভাবশালী অল আসাম স্টুডেন্টস’ ইউনিয়নের উপদেষ্টা সমুজ্জ্বল ভট্টাচার্য বলেন, গামোছা আমাদের অহংকার এবং আসামের সাংস্কৃতিক প্রতীক। আসামি জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি কারও অশ্রদ্ধা করা ঠিক না।

সমালোচনা ও নিন্দা এত প্রবল ছিল যে ২৮ মার্চ বাংলা সাহিত্য সভা দুঃখপ্রকাশ করে একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়। আসাম ও বাঙালি সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে বিতর্কিত কাপড়টিকে উল্লেখ করেছে সংগঠনটি।

বিজেপি সমালোচকরা বলছেন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি

রাজ্যে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-এর সমালোচকরা এই ঘটনাটিকে এত হালকা করে দেখতে রাজি না। অনুষ্ঠানটিতে দলটির সিনিয়র নেতা ও রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি সমালোচকদের আরও রসদ জুগিয়েছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী রানোজ পেগু, বিজেপির সিনিয়র নেতা শিলাদিত্য দেব। তিনি আবার রাজ্যের সংখ্যালঘু ভাষা উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারপারসন।

অ্যাক্টিভিস্ট থেকে রাজনীতিকে পরিণত হওয়া অখিল গগৈ অভিযোগ করেছেন, ২৫ মার্চের আয়োজন ছিল বিজেপির হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ক্ষেত্র। তিনি বলেন, বিজেপির রাজনীতি এখন হিন্দু বাঙালিদের ঘিরে, যারা ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছে। হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার অংশ হিসেবে এদেরকে আসামি সমাজের অংশে পরিণত করতে চাইছে বিজেপি। সাম্প্রতিক গামোছা কাণ্ড ছিল এই রাজনীতির অংশ।

পুরনো উদ্বেগ

সিবসাগরের আইনপ্রণেতারা আসামি জনগণের একাংশের মনে থাকা পুরনো উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ থেকে আসা অনথিভুক্ত মানুষদের নিয়ে আসামিদের একাংশের উদ্বেগ বহু পুরনো। বিজেপির নেতৃত্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্তে এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে।

রাজ্যের অনেকে মনে করেন, এর ফলে আসাম চুক্তির লঙ্ঘন হচ্ছে। এই চুক্তির আওতায় ভারতের নাগরিকত্ব আইনে আসামের জন্য বিশেষ ধারা রাখা হয়েছে। এ্ ধারা অনুসারে, যারা ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের আগে প্রবেশ করেছেন তারা এবং তাদের উত্তরাধিকারীরা আসামে ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

বিজেপি নিজের আইন তৈরি করছে

আসামে কাদেরকে বিদেশি বলে মনে করা হবে তা সম্পর্কে বিজেপির নিজস্ব ভাবনা রয়েছে। দলটির কাছে বিদেশি হলেন মুসলিম বাঙালিরা। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আসামে যখন বিক্ষোভ হয় তখন গামোছা ছিল প্রতিবাদকারীদের একটি প্রতীক। দলের নেতারা বলছেন, হিন্দু বাঙালিদের নিয়ে দুশ্চিন্তা করার মতো কিছু নেই। তাদের দাবি, আসামি ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জন্য হুমকি হলো মুসলিম বাঙালিরা।

গত বছর আসামের সংস্কৃতি ও পরিচয়ের রক্ষক হিসেবে দাবি করা বিজেপির নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার একটি জাদুঘর সংশ্লিষ্ট তিন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছিল। বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতির প্রদর্শনের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

‘বিজেপির কাছে বাঙালি অর্থ হিন্দু বাঙালি’

বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার শিলচরের কাছাড় কলেজের শিক্ষক জয়দ্বীপ বিশ্বাসের দাবি, আসামি ও বাঙালিদের বিভেদ ঘুচাতে গামোছা ও গামছাকে এক সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার বিষয়টি সন্দেহজনক। আসামি গামোছা আসামিদের পরিচয়, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু বাঙালিদের কাছে গামছার নির্দিষ্ট কোনও গুরুত্ব নেই।

তিনি বলেছেন, বাঙালি গামছা হিন্দু ধর্মীয় রীতিতে ব্যবহৃত হয়। বিজেপির কাছে বাঙালি মানে হলো হিন্দু বাঙালি। কিন্তু বাঙালিরা আসামিদের মতো একটি ভাষাগত সম্প্রদায়।

বিশ্বাস আরও উল্লেখ করেছেন, বাংলা সাহিত্য সভা সংগঠনটির বিভিন্ন পদে থাকা ব্যক্তিরা হিন্দু বাঙালি। সংগঠনটিতে মুসলিম বাঙালিদের রাখা হয়নি। বিজেপির রাজনীতি হলো ভাষা, জাতির ভিন্নতা থাকা বৃহত্তর হিন্দুদের একত্রিত করা। এটি করেই বিজেপি দেশে একের পর এক নির্বাচনে জয়ী হচ্ছে।

একজন বিতর্কিত রাজনীতিক

রাইজর দল নামের আঞ্চলিক দলের নেতা গগৈ বলছেন, সংগঠনটিতে শিলাদিত্য দেবের ভূমিকা প্রধান পৃষ্ঠপোষকের। এর ফলে এটির লক্ষ্য স্পষ্ট। তিনি অভ্যাগতভাবে আক্রমণকারী। অতীতে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন।

কংগ্রেসের মুখপাত্র ববিতা শর্মাও শিলাদিত্য দেবের সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, বিজেপির নেতাদের জবাবদিহি হওয়া উচিত। সম্প্রদায়ের সম্প্রীতির প্রকাশ হওয়া উচিত ভালোবাসা ও মানুষের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধার মাধ্যমে। গামোছা ও গামছাকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে নয়।

শিলাদিত্য দেব অনুষ্ঠানটি নিয়ে কথা বলার সময় ছিলেন অকপট। বিজেপি নেতা উল্লেখ মঞ্চে ছিল চৈতন্য মহাপ্রভু ও শ্রিমন্ত সংকরদেবার ছবি। এই দুজন যথাক্রমে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের গুরুত্বপূর্ণ নব্য-বৈষ্ণব সাধক।

তিনি বলেন, আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল আমরা কি শ্রিমন্ত সংকরদেবার সঙ্গে চৈতন্য মহাপ্রভু সঙ্গে কাজ করব নাকি আজান ফকিরের সঙ্গে।

ধারণা করা হয়, মধ্যযুগে আসামে সুফি ইসলামের প্রবর্তন করেছিলেন আজান ফকির। তাকে স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে মনে করা হয়। আসামকে অনেক সময় ‘সংকরদেব-আজান বা ডেক্স’, ‘সংকরদেবা ও আজানের’ ভূমি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এটি মানতে রাজি নন শিলাদিত্য দেব। তিনি বলেন, সংকর-মহাদেবের ভূখণ্ড হিসেবে পরিচিত আসাম, সংকর-আজানের নয়। আজান ফকির বাগদাদ থেকে এসেছিলেন। তিনি আমাদের নারী ও আসমীয়াদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করেন।

অবশ্য এই ঘটনায় বিজেপির আনুষ্ঠানিক বক্তব্য ছিল অনেক কৌশলী। দলের মুখপাত্র রুপম গোস্বামী বলেছেন, সাহিত্য সংগঠনের উদ্দেশ্য হয়ত মহৎ, কিন্তু আসামের ভূরাজনীতিতে গামোছার গুরুত্বের কারণে এটিকে টেনে আনা উচিত হয়নি। আয়োজকরা যদি ইচ্ছাকৃতভাবে এমনটি করে থাকেন তাহলে নিন্দা জানানো উচিত।

সাবস্ক্রাইব
Notify of
guest
0 মন্তব্য
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন