বিশ্ব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরেই নেতৃত্বের দাবিদার। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এক নীরব পরিবর্তন ঘটছে। মঞ্চের আলোয় পশ্চিমারা যতটা সরব, মঞ্চের পেছনে চীন ততটাই দৃঢ়ভাবে নিজের অবস্থান গড়ে নিচ্ছে। তাদের কৌশল হলো ‘সফট ডিপ্লোমেসি’, যেখানে শব্দ কম, কিন্তু প্রভাব গভীর। তাই বিশ্ব রাজনীতির মানচিত্রে এক নতুন ভারসাম্য গড়ে উঠছে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া যখন প্রকাশ্য সংঘাতে ব্যস্ত, তখন চীন নীরব কৌশলে তার প্রভাব বিস্তার করছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ পর্যন্ত সবখানেই চীনের উপস্থিতি এখন এক অবিচ্ছেদ্য বাস্তবতা।
২০২৩ সালের মার্চে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে ঐতিহাসিক পুনর্মিলন ঘটায় চীন। দীর্ঘ দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের একক প্রভাব ছিল; অথচ সেই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় দুই প্রতিদ্বন্দ্বীকে আলোচনার টেবিলে বসাতে পেরেছিল বেইজিং। প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান তখন মন্তব্য করেছিল, ‘চীন কি এখন নতুন মধ্যপ্রাচ্যের স্থপতি’। গার্ডিয়ানের কূটনৈতিক সম্পাদক প্যাট্রিক উইনটোর এক বিশ্লেষণে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক বিকল্প হিসেবে নিজের অবস্থন দৃঢ় করেছে চীন।
একই সময়ে আফ্রিকায়ও চীনের উপস্থিতি বেড়েছে বহুগুণ। গত দুই বছরে নাইজার, মালি, গ্যাবন ও বুরকিনা ফাসোতে সামরিক অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমা প্রভাব কমে গেছে, আর চীনা কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলোর নতুন চুক্তি বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। দ্য আটলান্টিক এর বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘চীন এমনভাবে বিনিয়োগ করছে যে, আফ্রিকা আর আগের মতো পশ্চিমা সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল নয়।’
আফ্রিকান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক সেন্টারের গবেষণা সহযোগী পল নানতুলিয়া বলেন, আফ্রিকায় নিরাপত্তা বলয় বৃদ্ধি করা আসলে বৈশ্বিকভাবে নিজেদের নিরাপত্তা পরিকল্পনার বড় অংশ চীনের।
নিরাপত্তা সংযুক্তির আয়োজন বাড়িয়ে আফ্রিকায় চীনের প্রভাব বৃদ্ধি শীর্ষক এক নিবন্ধে আফ্রিকা বিষয়ক এই বিশেষজ্ঞ বলেন, চীন-আফ্রিকা সহযোগিতা ফোরাম ফোক্যাক (FOCAC)-এর নতুন বেইজিং অ্যাকশন প্ল্যান (২০২৫–২০২৭)-এ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিরাপত্তা-সংক্রান্ত প্রতিশ্রুতি যুক্ত হয়েছে। এটি ইঙ্গিত করে, আফ্রিকায় অর্থনৈতিক প্রভাবের পাশাপাশি নিরাপত্তা খাতেও বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে চায় চীন।
২০০০ সালে যখন ফোক্যাক গঠিত হয়, তখন আফ্রিকার অস্ত্রভাণ্ডারের পাঁচ শতাংশেরও কম ছিল চীনা উৎপাদিত। সেই সময় চীনের সামরিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আফ্রিকার মাত্র ২০০ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল, এবং কোনো সামরিক মহড়াও পরিচালিত হয়নি মহাদেশটিতে। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে, চীন প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার আফ্রিকান সামরিক কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং আফ্রিকার অন্যতম শীর্ষ অস্ত্র সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে আফ্রিকার প্রায় ৭০ শতাংশ দেশ চীনা সাঁজোয়া যান ব্যবহার করছে।
একই সময়ে, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথাগত প্রভাব ধরে রাখতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। চলতি বছর মে মাসে কূটনীতি বিষয়ক সাময়িকী ফরেন অ্যাফেয়ার্স-এ ‘আন্ডারএস্টিমেটিং চায়না’ শীর্ষক প্রকাশিত প্রবন্ধে বিশ্লেষকরা লিখেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব বহুদিন ধরে চীনের কূটনৈতিক সক্ষমতাকে অবমূল্যায়ন করেছে। জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা অধ্যায়ন বিষয়ক বিভাগের অধ্যাপক ও বিশেষজ্ঞ রাস ডোসি ও দ্য এশিয়া গ্রুপে সহপ্রতিষ্ঠাতা কার্ট এম ক্যাম্পবেল তাদের যৌথ নিবন্ধে বলেন, চীন এখন এমন এক প্রভাব বলয় গড়ে তুলেছে যা পশ্চিমাদের সামরিক জোটের বাইরে থেকেও বাস্তব ফল দিচ্ছে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও চীন এখন এক ভিন্ন ধারায় চলছে। যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী জোট হিসেবে পরিচিত ব্রিকস (BRICS) সম্প্রসারণের মাধ্যমে সৌদি আরব, ইরান, মিশর ও ইথিওপিয়াকে যুক্ত করা হয়েছে, যা কার্যত যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন জি সেভেন ব্লকের বিকল্প শক্তি তৈরি করছে। বেইজিং এখন এমন একটি আর্থিক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে যেখানে লেনদেনের মুদ্রা হিসেবে ইউয়ান ধীরে ধীরে ডলারের জায়গা নিচ্ছে। আর সেখানে তাদের আরও জোরাল অবস্থান করছে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে চীন ইতিমধ্যেই ১৫০টিরও বেশি দেশে বিনিয়োগ করেছে, যা এক প্রকার বিকল্প বিশ্বায়নের রূপরেখা তৈরি করছে। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অবকাঠামো নির্মাণে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে, যেখানে পশ্চিমা ঋণদাতারা ক্রমেই প্রভাব হারাচ্ছে।
এশিয়ার মঞ্চেও চীনের কৌশল বদলে যাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের সঙ্গে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের মধ্যেও চীন কোনো সরাসরি যুদ্ধচেষ্টা নেয়নি, বরং ‘গ্রে জোন’ কৌশলে ক্রমশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। যুক্তরাষ্ট্র সামরিক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, কিন্তু ফিলিপাইনের অর্থনীতি চীনা বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। আর এই বাস্তবতা বেইজিংয়ের কূটনীতিকে আরও কার্যকর করে তুলেছে।
সবশেষ ‘রেয়ার আর্থ’ উপাদান বা দুর্মূল্য এই খনিজ রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপের সিদ্ধান্তও পশ্চিমাদের জন্য বড় ধাক্কা। এই উপাদান ছাড়া আধুনিক চিপ বা ইলেকট্রনিক যন্ত্র উৎপাদন প্রায় অসম্ভব। ফলে পশ্চিমা দেশগুলো এখন ‘সবুজ প্রযুক্তির’ ভবিষ্যৎ নিয়েও চীনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে। ফরেন অ্যাফেয়ার্স এর ভাষায়, ‘চীন এখন বাণিজ্য নয়, কৌশল দিয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে।’
ট্রুথআউটে প্রকাশিত নিবন্ধে বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র একটি পতনশীল শক্তি, যার একক আধিপত্যের যুগ শেষ।’ তার মতে, চীন পশ্চিমা শক্তির মতো প্রতিক্রিয়াশীল নয়, বরং পরিকল্পিত ও ধীর কৌশলে এগোয়—যা বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় তাদের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করছে।
চমস্কি বলেন, ‘পশ্চিমাদের নীতি প্রতিক্রিয়াশীল, তারা ঘটনার পর সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদিকে চীনের নীতি পরিকল্পিত, তারা আগে থেকেই জানে, পরবর্তী দশকে কোথায় দাঁড়াবে।’ তাদের এই কৌশলই চীনকে কূটনৈতিকভাবে এগিয়ে রাখছে।
চীনের আরেকটি বড় সাফল্য হলো নিজেকে “নন ইন্টারফেয়ারিং পাওয়ার’ হিসেবে উপস্থাপন করা। তারা যেকোনো দেশের সঙ্গে কাজ করে, শর্ত আরোপ না করেই। এ কারণেই আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো এখন চীনের কাছাকাছি যেতে চাইছে।
আজ যখন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেন যুদ্ধে ক্লান্ত, ইউরোপ জ্বালানিসঙ্কটে বিপর্যস্ত, তখন চীন নীরবে নিজস্ব বৃত্তে প্রভাব বিস্তার করছে। একে কেউ বলছে সাইলেন্ট ডিপ্লোমেসি, আবার কেউ বলছে সফট ডিপ্লোমেসি। তবে ফল একটাই, বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণ বদলে যেতে শুরু করেছে।
চীন এখন সরাসরি মুখোমুখি সংঘর্ষে নয়, বরং অর্থনীতি ও কূটনীতির যৌথ অস্ত্র ব্যবহার করছে। এতে করে তারা এমন এক ভারসাম্য তৈরি করেছে, যেখানে শক্তি প্রদর্শনের বদলে নির্ভরযোগ্যতা হয়ে উঠছে প্রভাব বিস্তারের প্রধান উপাদান। আর ঠিক এখানেই পশ্চিমা কূটনীতি হারছে তাদের কাছে।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ট্রুথআউট, আফ্রিকান সেন্টার, দ্য কনভারসেশন