থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার বিবাদপূর্ণ সীমান্তে সামরিক সংঘাতে কমপক্ষে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে থাই কর্তৃপক্ষ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে আসা বিরোধের তীব্রতা বাড়িয়ে তুলেছে সাম্প্রতিক এই সংঘর্ষ।
থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, হতাহতদের বেশিরভাগই বেসামরিক নাগরিক। তবে হতাহতের বিষয়ে কম্বোডিয়া এখনো কিছু জানায়নি।
দু’পক্ষের মধ্যে আজ বৃহস্পতিবার সকালে গুলি বিনিময় হয়। উভয়পক্ষেরই দাবি, অপরপক্ষ প্রথমে গুলি চালিয়েছে।
একদিকে থাইল্যান্ড অভিযোগ তোলে, কম্বোডিয়া তাদের লক্ষ্য করে রকেট নিক্ষেপ করছে। অন্যদিকে, কম্বোডিয়া অভিযোগ করে, ব্যাংকক তাদের সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে বিমান হামলা চালাচ্ছে। এই পাল্টাপাল্টি অভিযোগকে কেন্দ্র করে বিষয়টা দ্রুত গুরুতর হয়ে ওঠেছে।
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সংঘর্ষের কারণ
দুই দেশের মধ্যে এই বিরোধিতা একশো বছরেরও বেশি আগের। কম্বোডিয়ায় ফরাসি দখলদারিত্বের পর দুই দেশের মধ্যে এই সীমান্ত তৈরি হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিস্থিতি খারাপ হয় ২০০৮ সালে। যখন ক্যাম্বোডিয়া বিতর্কিত এলাকায় অবস্থিত একাদশ শতাব্দীর একটা মন্দিরকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে নিবন্ধিত করার চেষ্টা করে। থাইল্যান্ড এই পদক্ষেপের তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
দুই দেশের মধ্যে চলে আসা এই বিরোধের জেরে বছরের পর বছর ধরে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে উভয় পক্ষের সৈন্য ও বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু হয়েছে।
সাম্প্রতিক সময় গত মে মাসে সংঘর্ষের সময় কম্বোডিয়ার এক সেনার মৃত্যুর পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়। এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে তলানিতে নেমে আসে।
গত দুই মাসে দুই দেশই একে অন্যের বিরুদ্ধে সীমান্তবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কম্বোডিয়া থাইল্যান্ড থেকে ফল ও সবজি আমদানি নিষিদ্ধ করেছে এবং বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট পরিষেবা আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে।
এদিকে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দুই দেশই সীমান্তে নিজেদের সেনা উপস্থিতি আরও জোরদার করেছে।
সাম্প্রতিক ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ দিল থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়া
থাইল্যান্ডের ন্যাশানাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (এনএসসি) বা জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ দাবি করেছে, বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৭টার পর কম্বোডিয়ার সামরিক বাহিনী সীমান্তের কাছে থাই সেনাদের ওপর নজরদারি চালাতে ড্রোন মোতায়েন করে। এর কিছুক্ষণ পরেই কম্বোডিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রকেট চালিত গ্রেনেড নিয়ে সীমান্তের কাছে জড়ো হন।
এমন পরিস্থিতিতে থাই সৈন্যরা চিৎকার করে আলাপ-আলোচনার চেষ্টা করলেও তা ব্যর্থ হয়।
এনএসসির মুখপাত্র জানিয়েছেন, কম্বোডিয়ার সৈন্যরা ৮টা বেজে ২০ মিনিটের দিকে তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এর পাল্টা জবাব দিতে বাধ্য হয় থাই সামরিক বাহিনী।
থাইল্যান্ডের অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে বিএম-২১ রকেট লঞ্চার এবং আর্টিলারিসহ মোতায়েন করা ভারী অস্ত্র ব্যবহার করেছিল কম্বোডিয়া। এর ফলে সীমান্তের থাই পক্ষে অবস্থিত একটা হাসপাতাল, একটা পেট্রোল স্টেশনসহ বাড়িঘর এবং সরকারি স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অন্যদিকে, কম্বোডিয়ার পাল্টা দাবি, সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছে থাই সৈন্যরা। তারা জানিয়েছে, সকাল সাড়ে ৬টার দিকে সীমান্তের কাছে একটা খেমার-হিন্দু মন্দিরের দিকে অগ্রসর হয় এবং তার চারপাশে কাঁটাতার স্থাপন করে পূর্বের চুক্তি লঙ্ঘন করে থাই সেনাবাহিনী।
কম্বোডিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যালি সোচিতা জানিয়েছেন, সকাল ৭টার পর থাই সেনারা একটা ড্রোন মোতায়েন করে এবং সকাল সাড়ে ৮টার দিকে ‘শূন্যে গুলি’ ছোঁড়ে।
তাকে উদ্ধৃত করে নমপেন পোস্ট জানিয়েছে, ৮টা ৪৬ মিনিটে থাই সৈন্যরা ‘প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে’ কম্বোডিয়ান সৈন্যদের ওপর গুলি চালায়। তাদের কাছে আত্মরক্ষার অধিকার প্রয়োগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
ম্যালি সোচিতা থাইল্যান্ডের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন, ভারী অস্ত্র ব্যবহার এবং কম্বোডিয়ার ভূখণ্ডে বিমান হামলার পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন।
কোন দিকে যাচ্ছে পরিস্থিতি?
থাইল্যান্ডের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী ফুমথাম ওয়েচায়াচাই জানিয়েছেন, কম্বোডিয়ার সঙ্গে তাদের বিরোধের বিষয়টা ‘স্পর্শকাতর’। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এবং সতর্কতার সঙ্গে এর সমাধান করতে হবে।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত জানিয়েছেন, তার দেশ শান্তিপূর্ণভাবে এই বিরোধের সমাধান করতে চায়। তবে তিনি বলেছেন, ‘সশস্ত্র আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র শক্তি দিয়ে জবাব দেওয়া ছাড়া তাদের আর অন্য কোনো বিকল্প নেই।’
তবে দুই দেশের মধ্যে গুরুতর গুলি বিনিময় তুলনামূলকভাবে দ্রুত হ্রাস পেয়েছে।
বর্তমান সংঘর্ষ পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে হলেও উভয় দেশেই এই সংঘাত থেকে সরে আসার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী ও আত্মবিশ্বাসী নেতৃত্বের অভাব রয়েছে।
কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেত, এমন এক ব্যক্তির ছেলে যিনি একসময় প্রভাবশালী ছিলেন। এখনো হুন মানেতের নিজস্ব কর্তৃত্ব নেই। তার বাবা হুন সেন জাতীয়তাবাদী চেতনা বাড়াতে এই দ্বন্দ্বকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক বলে মনে করা হচ্ছে।
থাইল্যান্ডে নড়বড়ে জোট সরকার রয়েছে, যা আরেক সাবেক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, থাকসিন সিনাওয়াত্রার সমর্থনপুষ্ট। থাকসিন সিনাওয়াত্রা মনে করতেন; তার সঙ্গে হুন সেন এবং তার পরিবারের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক। কিন্তু ব্যক্তিগত কথোপকথন ফাঁস করে হুন সেনের পক্ষ থেকে তাকে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। এই কথোপকথন ফাঁসের পর মেয়ে পাইতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
উভয় দেশই ‘সর্বোচ্চ’ সামরিক শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করবে
আল জাজিরার এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আলোচনার আগে উভয় দেশই ‘সর্বোচ্চ’ সামরিক শক্তি প্রয়োগের চেষ্টা করবে। ফিউচার ফোরামের নীতিগবেষক আউন চেংপোর আল জাজিরাকে বলেছেন, কয়েক সপ্তাহ ধরে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা উভয় দেশকে ‘কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং অভূতপূর্ব সামরিক সংঘাতের’ দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আউন চেংপো আরও বলেছেন, আজ বৃহস্পতিবারের আগে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে কূটনৈতিক ও কৌশলগত পতনের ঘটে। ফলে দেশ দুটি সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই মুহূর্তে কূটনৈতিক আলোচনার পথ বন্ধ হয়ে গেছে। তাই, আমরা বলতে পারি, এই সংঘাত সপ্তাহ বা মাস স্থায়ী হবে পারে।
উভয় দেশের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে উভয় পক্ষই আলোচনার জন্য মীমাংসার আগে সর্বোচ্চ সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করবে, বলেন ফিউচার ফোরামের নীতিগবেষক আউন চেংপো।
এমন পরিস্থিতিতে উভয় দেশের সংঘাত আরও বাড়তে পারে।