সুদানে দুই বছরের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সেনাবাহিনী ও আধা-সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)–এর মধ্যে সংঘাত শুরুর পর থেকে দেশজুড়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এ মুহূর্তে সুদানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট চলছে। দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়েছে, গৃহহীন প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দেশজুড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পালাচ্ছে।
কেন শুরু হলো এই গৃহযুদ্ধ?
সুদানের বর্তমান অস্থিতিশীলতার সূত্রপাত ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশির–এর পতনের মধ্য দিয়ে। তিন দশক ক্ষমতায় থাকা বশিরকে সরাতে সেনাবাহিনী ও বেসামরিকদের বিক্ষোভে দেশ কাঁপে। সেনারা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা নেয়, পরে জনগণের চাপের মুখে বেসামরিকদের সঙ্গে যৌথ সরকার গঠন করে।
কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবরে আরেকটি অভ্যুত্থান এই সরকারকেও উৎখাত করে। এই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে ছিলেন জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান, সেনাপ্রধান ও বর্তমান প্রেসিডেন্ট, এবং জেনারেল মোহামেদ হামদান দাগালো, যিনি আরএসএফের কমান্ডার—জনপ্রিয় নাম হেমেডটি।
বন্ধুত্ব থেকে বৈরিতা
বশিরের পতন ও পরবর্তী ক্ষমতা ভাগাভাগিতে একসময় একসঙ্গে কাজ করা এই দুই জেনারেল পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। সেনাবাহিনীতে আরএসএফের সৈন্যদের একীভূতকরণ ও নেতৃত্বের প্রশ্নেই মূল দ্বন্দ্ব শুরু হয়। ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে আরএসএফের সৈন্যদের মাঠে নামানোর পর পরিস্থিতি বিস্ফোরণ ঘটে—শুরু হয় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ।
কারা আরএসএফ?
আরএসএফ বাহিনী গঠিত হয় ২০১৩ সালে, মূলত দারফুরের কুখ্যাত জানজাওয়িদ মিলিশিয়া থেকে। তাদের বিরুদ্ধে ২০০০-এর দশকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল। প্রেসিডেন্ট বশিরই এই বাহিনীকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেন। পরে দাগালো একে একটি শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন, যা এখন সেনাবাহিনীর প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
এই বাহিনী ইয়েমেন ও লিবিয়ার সংঘাতেও অংশ নেয় এবং সুদানের সোনার খনির বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণও নিজেদের হাতে নেয়। এর ফলে দাগালো দ্রুত ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠেন।
যুদ্ধের মানচিত্র
সুদানের উত্তর ও পূর্বাঞ্চল সেনাবাহিনীর দখলে, আর পশ্চিম ও দক্ষিণের বড় অংশ—বিশেষ করে দারফুর ও কোর্দোফান অঞ্চল—আরএসএফের নিয়ন্ত্রণে। রাজধানী খার্তুম দুই পক্ষের লড়াইয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
দারফুরে গণহত্যা ও সহিংসতা
সম্প্রতি দারফুরের এল-ফাশের শহর দখলের পর আরএসএফ বাহিনীর বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। জাতিসংঘ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানিয়েছে, স্থানীয় মাসালিট ও অনারব জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, ধর্ষণ ও নির্বিচার হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছে। এমনকি শিশুদের ওপরও যৌন সহিংসতার অভিযোগ রয়েছে।
জাতিসংঘ তদন্তে উঠে এসেছে, আরএসএফ সেনারা যৌন আক্রমণের সময় বলেছে—“তোমাদের গর্ভে আমরা আরব সন্তান দেব।” এই বিবৃতিই সংঘাতের ভয়াবহ জাতিগত চরিত্রের ইঙ্গিত দেয়।
দ্বিতীয়বার ভাঙনের আশঙ্কা
বর্তমানে আরএসএফ সুদানের বড় অংশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং ‘নিজস্ব সরকার’ ঘোষণার দাবি করছে। এতে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, ২০১১ সালের মতো আবারও সুদান বিভক্ত হয়ে পড়তে পারে।
অর্থনীতি ও মানবিক বিপর্যয়
সুদান আফ্রিকার অন্যতম বৃহৎ দেশ, আয়তন প্রায় ১৯ লাখ বর্গকিলোমিটার। একসময় বিশ্বের অন্যতম স্বর্ণ উৎপাদনকারী দেশ হলেও দীর্ঘ গৃহযুদ্ধে অর্থনীতি ধ্বসে পড়েছে। সরকারি আয় কমেছে প্রায় ৮০ শতাংশ। ৪ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার দেশটির মাথাপিছু আয় এখন মাত্র ৭৫০ ডলার।
গৃহযুদ্ধের আগুনে খাদ্য, ওষুধ ও আশ্রয়—সবকিছুই আজ অপ্রতুল। জাতিসংঘ বলছে, এ সংকট যদি দ্রুত বন্ধ না হয়, তাহলে সুদানের বিপর্যয় আফ্রিকার সীমা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয়ে রূপ নেবে।
