পাকিস্তানের অন্যতম বড় শহর লাহোরের উপকণ্ঠে একটা ফার্মহাউসের আশপাশে একটা অদ্ভুত গন্ধ পাওয়া যায়। ভেতরে প্রবেশ করলেই অবশ্য কারণটা স্পষ্ট হয়ে যায়। এখানে ২৬টি সিংহ, বাঘ আর তাদের সন্তান-সন্ততিরা থাকে। সঙ্গে থাকেন এদের মালিক ফায়াজ। তিনি বলছিলেন, ‘পশুরা এখানে আরামেই আছে। ওরা আমাকে দেখেই কাছে চলে আসে, খাবার খায়। আক্রমণ করে না অবশ্য।’
তবে যেই তিনি এই কথাগুলো বললেন, ঠিক তখনই খাঁচায় বন্দি একটা সিংহ গর্জন করে উঠল। তখন অবশ্য মি. ফায়াজ বললেন, ‘এ একটু আক্রমণাত্মক, ওর প্রকৃতিটাই এরকম।’
বাঘ আর সিংহদের সঙ্গে ফায়াজের খুব মধুর সম্পর্ক। সাধারণ মানুষ তো কুকুর-বেড়াল এসব পুষেই থাকেন, তবে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে ‘বিগ ক্যাটস’ অর্থাৎ সিংহ, বাঘ বা চিতা পোষার চল আছে।
সপ্তাহ দুয়েক আগে লাহোরে এরকমই একটি ‘গৃহপালিত’ সিংহ এক নারী ও দুটি শিশুর ওপরে হামলা করার পরে সাধারণ মানুষ অসন্তুষ্ট হন। আবার বেআইনিভাবে বাঘ-সিংহ যারা পুষছেন, তাদের বিরুদ্ধে একটা বিশেষ অভিযান শুরু করেছে সরকারও।
পাকিস্তানে যারা ব্যক্তিগতভাবে বাঘ-সিংহ পোষেন, তাদের মধ্যে ফায়াজের ফার্মহাউসটাই সবথেকে বড় বলে মনে করা হয়। ৩৮ বছর বয়সী ফায়াজ গত প্রায় ১০ বছর ধরে সিংহ-শাবক আর প্রজননের জন্য সিংহ-সিংহীর জোড় বিক্রি করে থাকেন। পাকিস্তানে তিনিই সম্ভবত সবথেকে বড় সিংহ বিক্রেতা।
বাঘ, সিংহ, পাহাড়ি সিংহ, চিতা, জাগুয়ার ইত্যাদি পোষা গত কয়েক দশক ধরেই পাকিস্তানে ক্ষমতা, সামাজিক অবস্থান এমনকি রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লীগ- নওয়াজ গোষ্ঠীর নির্বাচনি প্রতীকও হলো বাঘ।
সাম্প্রতিক সময়ে টিকটক আর ইনস্টাগ্রামের মতো শর্ট-ভিডিও দেওয়ার সামাজিক মাধ্যমগুলোর প্রচলন যত বেড়েছে, ততই এ ধরনের পশু পালনের হিড়িক বেড়েছে। এখন তো বিয়ের অনুষ্ঠানেও বাঘ-সিংহ নিয়ে আসা শুরু হয়েছে।
তবে লাহোরে এক গৃহপালিত সিংহের পাঁচিল টপকিয়ে পালিয়ে গিয়ে রাস্তায় এক নারী ও তার দুই সন্তানের ওপরে হামলা করার ঘটনার পরে সরকার এ ব্যাপারে কঠোর হতে শুরু করেছে। এর প্রভাব দেখা যাচ্ছে ফায়াজের মতো অনেকের ওপরেই।
পাকিস্তানে বন্য প্রাণী পালনের নিয়ম
পাকিস্তানের নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটি পশুর নথিভুক্তিকরণের জন্য তার মালিককে এককালীন ৫০ হাজার পাকিস্তানি টাকা দিতে হবে। এছাড়াও একটি ফার্মে সর্বাধিক দুটি প্রজাতির মাত্র ১০টি পশু রাখা যাবে। এই নিয়ম ভঙ্গ করলে দুই লাখ পাকিস্তানি টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে এবং গুরুতর ক্ষেত্রে সাত বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে।
লাহোরের উপকণ্ঠে একটি ফার্মহাউসে দেখা গেছে যে একটা খাঁচাতেই বন্দি রয়েছে পাঁচটি সিংহ-শাবক। তার মধ্যেই সেগুলো ঘোরাফেরা করছে। খাঁচার ভেতরটা নোংরা হয়ে আছে।
এক বন্যপ্রাণী কর্মকর্তা নিজেই প্রশ্ন করছিলেন, ‘কিন্তু এই শাবকগুলোর মা-বাবা কোথায়?’
পাশেই কয়েকটা খাঁচা খালি পড়ে ছিল। বনবিভাগের কর্মীরা খবর পেয়েছিলেন যে ওখানে একজন ব্যক্তি অনুমোদন ছাড়াই সিংহ আর তার শাবকদের পুষছেন এবং অবৈধভাবে প্রজনন ঘটিয়ে বিক্রি করছেন।
কর্মকর্তারা সেখানে পৌঁছে দেখতে পান যে ফার্মহাউসের মালিক পালিয়ে গেছে, শুধু পশুগুলোর দেখাশোনার জন্য একজন ব্যক্তি ছিলেন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য একটা ট্রাকে চাপিয়ে যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তিনি বলেন, ‘আমাকে মাত্র দুই সপ্তাহ আগেই কাজে নিযুক্ত করা হয়েছে।’
কর্মকর্তাদের সন্দেহ যে শাবকগুলোর মা-বাবাকে মালিক সম্ভবত অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। উদ্ধার হওয়া সিংহ-শাবকগুলোকে এখন লাহোরের এক সরকারি চিড়িয়াখানায় রাখা হয়েছে। শারীরিক পরীক্ষার জন্য আলাদা আলাদা করে রাখা হয়েছে তাদের।