গাজায় ইসরায়েলের চলমান সামরিক অভিযানের সাতাশ মাস পর ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে এক নীরব গভীর মানসিক স্বাস্থ্য সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। মনস্তাত্ত্বিকরা একে ‘নৈতিক আঘাত’ (Moral Injury) হিসেবে চিহ্নিত করছেন। যা সৈন্যদের মধ্যে চরম অপরাধবোধ, লজ্জা এবং নিজের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম দিচ্ছে। এর ভয়াবহ পরিণতি হিসেবে আত্মহত্যা ও মনস্তাত্ত্বিক সাহায্য চাওয়ার ঘটনা রেকর্ড ভেঙেছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৮৫ হাজারেরও বেশি সৈন্য মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার সাহায্য চেয়েছেন। যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আত্মহত্যার পরিসংখ্যান ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। কেবল ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুলাই ২০২৫-এর মধ্যে কমপক্ষে ২৭৯ জন সৈন্য আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন এবং বেশ কয়েকজন মারা গেছেন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই সংকট কেবল যুদ্ধ-ভীতিজনিত পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার নয়। বরং এর মূল কারণ হলো নৈতিক আঘাত। মনোবিজ্ঞানী আসুদে বেইজা সাভাস-এর মতে, নৈতিক আঘাত বলতে বোঝায় নৈতিকভাবে এবং নীতিগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ কাজ। যেমন, এই ক্ষেত্রে গণহত্যার সংস্পর্শে আসার ফলে সৃষ্ট মানসিক কষ্ট। সৈন্যদের মধ্যে এই ধারণা জন্মেছে যে তারা এমন একটি রেখা অতিক্রম করেছেন যা আর পেরোনো সম্ভব নয়।
একজন রিজার্ভ অফিসার গত সপ্তাহে গাজা থেকে ফেরার পর তীব্র মানসিক কষ্টের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। আরেক ২১ বছর বয়সী সৈন্য আইনপ্রণেতাদের বলেছেন যে গাজা অভিযানে অংশ নেওয়ার কারণে তিনি এখন একটি চলন্ত লাশ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসামরিক মানুষ হত্যায় অংশ নেওয়া সৈন্যদের মধ্যে আত্মহত্যার অন্যতম শক্তিশালী পূর্বাভাস। মারমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের ড. আয়েশে সেনা সেজগিন বলেন, যখন সৈন্যরা তাদের নিজস্ব নৈতিক সীমানা অতিক্রম করে বলে মনে করে, তখন তারা নিজেদের ভালো মানুষ হিসেবে দেখা এবং ক্ষতি করার ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ বা জটিলতা মেনে নেওয়ার মধ্যে গভীর জ্ঞানীয় দ্বন্দ্বে ভোগে। এই দ্বন্দ্বে তীব্র অপরাধবোধ, লজ্জা ও অনুশোচনা জন্ম নেয়। সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি বৃদ্ধির এই চিত্র এখন ইসরায়েলি সমাজের একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয়। অনেক সৈনিকের স্ত্রীরা বর্ণনা করছেন যে তাদের স্বামীরা শারীরিকভাবে ফিরে এলেও মানসিকভাবে অনেক আগেই গাজায় মারা গেছেন।
সংকট আরও গভীর হয়েছে যখন কিছু জায়নবাদী গোষ্ঠী ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগকে নাটক বলে বর্ণনা করার চেষ্টা করছে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সৈন্যরা যা করেছে, সমাজ তা অস্বীকার করায় তাদের লজ্জা ও অপরাধবোধ ভেতরে আরও গভীরে প্রোথিত হচ্ছে।
দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে, এই মানসিক স্বাস্থ্য সংকট কেবল সৈন্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। মনোবিজ্ঞানী সেজগিন এবং সাভাস উভয়ই সতর্ক করেছেন যে এই নৈতিক আঘাত এবং দ্বিতীয় স্তরের আঘাতজনিত চাপ (secondary traumatic stress) তাদের পরিবার, বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে আন্তঃপ্রজন্মীয় আঘাত হিসেবে সঞ্চারিত হতে পারে। যা ইসরায়েলি সমাজের আগামী প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে। মানসিক সুস্থতা পুনরুদ্ধার করতে এবং সামাজিক শান্তি ফিরিয়ে আনতে জড়িতদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
