ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবির সংবাদ উপস্থাপক সাহার ইমামি আজ শুধু একটি নাম নয়, বরং প্রতিকূল মুহূর্তে দায়িত্ব পালনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। গত ১৬ জুন ইহুদিবাদী ইসরায়েল যখন আইআরআইবির তেহরানস্থ প্রধান কার্যালয়ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, তখন সাহার ছিলেন সরাসরি সম্প্রচারে।
চারদিকে আতঙ্ক, বিস্ফোরণ, ধ্বংসের ছাপ— তবু তিনি স্টুডিও ছাড়েননি।
সাহসিকতার সেই দিন
পর পর চারটি ক্ষেপণাস্ত্রের বিকট বিস্ফোরণে ভবন কেঁপে ওঠে। প্রথম হামলার সময়ই অধিকাংশ স্টাফ দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরে যান। স্টুডিওর প্যানেলে থাকা একজন কর্মকর্তা তখন সাহারকে বলেন, ‘ভয় পেয়ো না, অব্যাহত রাখো। ’ সাহার তা-ই করেন।
সেদিনের পরিস্থিতি সম্পর্কে ইরানের ইংরেজি প্রেস টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমি কিছুক্ষণের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। কারণ, বুঝতে পারছিলাম না এটা ভূমিকম্প, বিস্ফোরণ— নাকি ইসরায়েলি হামলা। তখন প্যানেলে উপস্থিত একজন অতিথি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ভয় পেয়ো না, অব্যাহত রাখো। ’ উনার এই কথাতেই আমি ভেতরে শক্তি পাই। ’
সাহার ইমামি আরও বলেন, ‘দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আমি লাইভ সম্প্রচার চালিয়ে যেতে থাকি। কারণ, মিডিয়ায় আমাদের দায়িত্ব শুধু সংবাদ পড়া নয়— বরং জাতির সাহস ও মনোবল ধরে রাখা। আমরা পেশাগত দিক থেকে দায়িত্ব পালন করছিলাম, কিন্তু সেটা পরিণত হয়েছিল এক ধরনের প্রতিরোধে। ’
সাহসী এই উপস্থাপিকা আরও বলেন, ‘আমি জানতাম না এরপর কী হবে। ভবনটা ধসে পড়বে কিনা তাও জানতাম না। কিন্তু আমি শুধু এটুকুই ভাবছিলাম, যদি আজ আমার জীবন শেষও হয়ে যায়, আমার সন্তান যেন জানে যে তার মা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছে। আমি চেয়েছি, ইরানের যুবসমাজ বুঝুক— সাহস মানে দায়িত্বে অবিচল থাকা। ’
এই নারী সাংবাদিকের সাহসিকতার ভিডিও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এরপর থেকে অনেকেই তাকে ‘ইরানের লৌহমানবী’ হিসেবে অভিহিত করেন।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি
এই অনন্য সাহসিকতা ও সাংবাদিকতায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সাহার ইমামি পেয়েছেন ভেনেজুয়েলার জাতীয় সাংবাদিকতা সম্মাননা ‘সাইমন বলিভার পুরস্কার’। ২৯ জুন, ভেনেজুয়েলার রাজধানী কারাকাসে ‘জাতীয় সাংবাদিকতা দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো ইরানি রাষ্ট্রদূত আলী শেগিনির হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এ সময় তিনি ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানান এবং বলেন, ‘তেহরানের মিডিয়া কার্যালয়ে হামলার পর সাংবাদিকরা যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন, তা বিশ্ব মিডিয়ার ইতিহাসেই বিরল। ’
কে এই সাহার ইমামি?
সাহার ইমামি জন্মেছেন ১৯৮৫ সালে, তেহরানে। পড়াশোনা করেছেন পরিবেশ ও কৃষি প্রযুক্তি বিষয়ে, প্রকৌশল ডিগ্রি রয়েছে তার ঝুলিতে। ২০০৮ সালে জাতীয় সম্প্রচার সংস্থা আইআরআইবিতে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। দীর্ঘ ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন আত্মবিশ্বাসী, মেধাবী এবং দায়িত্ববান গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে। বর্তমানে তিনি আইআরআইবি ৬ নম্বর চ্যানেলের প্রধান সংবাদ উপস্থাপক।
বহুমাত্রিক দক্ষতা ও প্রত্যয়ী কণ্ঠে উপস্থাপন তাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। বিবাহিত এই সংবাদকর্মীর রয়েছে একটি পুত্রসন্তান। সন্তানকে আদর্শ শেখানোর এক অন্য রকম উপায় হিসেবে তিনি নিজের পেশাগত দৃঢ়তাকেই বেছে নিয়েছেন।
একজন সহকর্মীর অভিজ্ঞতা
সাহার ইমামি ২০০৮ সালে আইআরআইবির টেলিভিশনে যোগ দেন। আর আমি, আইআরআইবির বাংলা অনুষ্ঠান বিভাগে যোগ দিই ২০০৩ সালে। সেই হিসেবে সাহার আমার সহকর্মী।
ইসরায়েলি হামলার দিন দুপুরে আমি নিজে ছিলাম ভবনটির রেস্টুরেন্টে, যেখানে অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে লাঞ্চ করছিলাম। তখনও ভাবিনি— একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাবে দখলদার ইসরায়েল।
ইসরায়েল পরপর চারটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়, উদ্দেশ্য ছিল মিডিয়ার কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। সাহার ইমামির সাহসিকতা আর আইআরআইবির প্রধান ড. পেইমান জেবেলির দৃপ্ত আহ্বান আমাদের মনোবল ফিরিয়ে দিয়েছে।
১৬ জুনের হামলার পর আজ (বুধবার) শোকাবহ মহররম উপলক্ষে আমাদের অফিস কম্পাউন্ডে অবস্থিত হজরত বেলাল (রা.) মসজিদে জোহরের নামাজের সময় আমরা সবাই একত্র হই। সেখানেই ড. জেবেলি আমাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখন মহররম মাস। আমরা বলি, কারবালায় থাকলে জান–মাল কুরবানি করতাম ইমাম হুসাইনের জন্য। বাস্তবে এখনই সেই সময় এসেছে। সত্য–মিথ্যার লড়াইয়ে আজ আমাদেরই হুসাইনের পথ অনুসরণ করতে হবে। সর্বশক্তি দিয়ে সত্য প্রচারে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই কারবালায় ইমাম হুসাইনের পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারীদের দলে স্থান পাওয়া যাবে, আল্লাহর কাছে সর্বোত্তম পুরস্কার লাভ করা সম্ভব হবে। ’
তার এই কথাগুলো আইআরআইবির প্রতিটি কর্মীকে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করেছে। সেই সঙ্গে সাহার ইমামির সাহস ও অদম্য মনোবল আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে।