English

24.3 C
Dhaka
মঙ্গলবার, জুলাই ৮, ২০২৫
- Advertisement -

ভারত ও পাকিস্তানের মাঝে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্ত

- Advertisements -

ভারত-পাকিস্তান, প্রতিবেশী দুই দেশ, চিরবৈরী দুই দেশ। সম্ভবত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে এই দুটি দেশের জনগণকে সবসময়ই ভঙ্গুর শান্তি ও সংঘাতের মাঝে টিকে থাকতে হয়। এই দুটি দেশের মধ্যে রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক সীমান্তের একটি।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ৭৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ইন্টারন্যাশানাল বর্ডার বা আন্তর্জাতিক সীমান্তসহ ৩ হাজার ৩২৩ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে।

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতি রেখা হিসাবে তৈরি হয়েছিল নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং ১৯৭২ সালের ‘সিমলা চুক্তি’র অধীনে তার নামকরণ করা হয়।

ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই কাশ্মীরকে সম্পূর্ণভাবে দাবি করলেও তারা তা আংশিকভাবে শাসন করে। কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে নিয়ন্ত্রণ রেখা, যা বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক সংঘাতের সীমান্তগুলোর মধ্যে একটা।

অস্থিতিশীল দুই দেশের এই ‘ডি ফ্যাক্টো সীমান্তের’ নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর যারা বসবাস করেন একমাত্র তারাই জানেন, দেশ দুটির খামখেয়ালিপনার শিকার হচ্ছেন তারা প্রতিনিয়ত।

সম্প্রতি পেহেলগাম হামলার ঘটনার পর ‘উত্তেজনা’ ভারত ও পাকিস্তানকে আরও একবার খাদের একেবারে কিনারে নিয়ে এসেছে। নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পাশে গোলাবর্ষণে সেখানকার বাড়ি-ঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, আর জীবন পরিণত হয়েছে ‘পরিসংখ্যানে’।

সাম্প্রতিক এই যুদ্ধ পরিস্থিতি এবং হামলায় ভারতে কমপক্ষে ১৬ জন এবং পাকিস্তানে ৪০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার তথ্য দিয়েছে দেশ দুটি। তবে গোলাবর্ষণের কারণে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে তা এখনো অস্পষ্ট।

এ বিষয়ে কানাডায় বসবাসরত পাকিস্তানি লেখিকা আনাম জাকারিয়া বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণরেখায় থাকা পরিবারগুলোকে ভারত ও পাকিস্তানের খেয়ালখুশি এবং (দুই দেশের মধ্যে) উত্তেজনার শিকার হতে হচ্ছে।’

পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীর নিয়ে একটা বই লিখেছেন তিনি। আনাম জাকারিয়ার কথায়, ‘প্রতিবার গুলি চলা শুরু হলে অনেকে বাঙ্কারে ঢুকে পড়েন, গবাদি পশু ও জীবিকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়, অবকাঠামো – বাড়িঘর, হাসপাতাল, স্কুলও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এই পরিস্থিতি এবং অস্থিরতা তাদের দৈনন্দিন বাস্তবতার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।’

কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে যাওয়া নিয়ন্ত্রণ রেখা বিশ্বের সবচেয়ে সামরিক সংঘাতের সীমান্তগুলোর মধ্যে একটা। এই অঞ্চলে সংঘাত কখনো ‘পিছিয়ে থাকে না’। সেখানে যুদ্ধবিরতি ঠিক ততটাই ‘টেকসই’, যতটা পরবর্তীতে যে কোনো ‘উস্কানিতে’ মুহূর্তে চিত্রটাকে বদলে দিতে পারে।

দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পররাষ্ট্রনীতি বিশেষজ্ঞ হ্যাপিমন জেকব বলেন, এখানে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন “লো লেভেল ফায়ারিং (কম পরিমাণে গুলি চালানো) থেকে শুরু করে বড় পর্যায়ের ভূমি দখল বা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক” পর্যন্ত হতে পারে। ভূমি দখল বলতে বল প্রয়োগ করে পাহাড়ের চূড়া, ফাঁড়ি বা বাফার জোনের মতো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানগুলো নিজেদের কব্জায় নেওয়া হতে পারে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নিয়ন্ত্রণরেখা ‘সংঘাতের মাধ্যমে সৃষ্ট এবং রক্ত দিয়ে টানা সীমান্তের’ উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

কানাডিয়ান লেখক জাকারিয়া ব্যাখ্যা করেছেন, “এটা এমন একটা রেখা যা কাশ্মীরিদের কথা বিবেচনা না করে ভারত ও পাকিস্তান টেনেছে এবং যেখানে সামরিকীকরণ ও অস্ত্রশস্ত্রের উপস্থিতি লক্ষণীয়।”

এ ধরনের ‘ওয়ারটাইম বর্ডার’ বা যুদ্ধকালীন সীমানা দক্ষিণ এশিয়ায় অনন্য নয়।

লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স-এর আন্তর্জাতিক ও তুলনামূলক রাজনীতির অধ্যাপক সুমন্ত্র বসু জানিয়েছেন, এ ধরনের সীমান্তের ক্ষেত্রে সবচেয়ে সুপরিচিত হলো ১৯৪৯ সালের ‘গ্রিন লাইন’, যা ইসরায়েল ও পশ্চিম তীরের মধ্যে সাধারণ সীমানা হিসাবে স্বীকৃত।

প্রসঙ্গত, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ২০২১ সালে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর (ভারত ও পাকিস্তান) মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর থেকে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর যে ‘আপাত শান্ত পরিস্থিতি’ বিরাজ করছিল, তা সাম্প্রতিক সংঘর্ষের আবহে সহজেই ভেঙে গিয়েছে।

কার্নেগি ইন্ডিয়ার সূর্য ভালিয়াপ্পান কৃষ্ণ বলেন, ‘নিয়ন্ত্রণরেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে সাম্প্রতিক সময়ের উত্তেজনা তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ এর আগে চার বছর সীমান্তে তুলনামূলক শান্তি দেখা গিয়েছিল।’

তবে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে সহিংসতা নতুন কোনও ঘটনা নয়। ২০০৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তির আগে, ২০০১ সালে ৪,১৩৪ বার এবং ২০০২ সালে ৫,৭৬৭ বার যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের ঘটনার অভিযোগ তুলেছে ভারত।

প্রাথমিকভাবে ২০০৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তি বহাল ছিল, যদিও ২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এর ‘নগণ্য লঙ্ঘন’ দেখা গিয়েছে। তবে ২০০৮ সালে আবার উত্তেজনার পরিবেশ তৈরি হয় এবং ২০১৩ সালের মধ্যে তা তীব্রভাবে বৃদ্ধি পায়।

অন্যদিকে, ২০১৩ থেকে শুরু করে ২০২১ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত, নিয়ন্ত্রণ রেখা এবং আন্তর্জাতিক সীমান্ত বড় ধরনের সংঘাতের সাক্ষী থেকেছে। এরপর ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নতুন করে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত তাৎক্ষণিক এবং ধারাবাহিকভাবে যুদ্ধবিরতির লঙ্ঘনের ঘটনা হ্রাস পেয়েছিল।

সম্প্রতি পেহেলগাম হামলার ঘটনার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে, ভারতের পক্ষ থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ জল-বণ্টন চুক্তি যা সিন্ধু জল চুক্তি নামে পরিচিত, তা স্থগিত করা হয়। পাকিস্তান ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায়। সিমলা চুক্তি নিয়ন্ত্রণ রেখাকে আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল – যদিও তা পুরোপুরি মেনে চলা হয়নি বলেই অভিযোগ।

‘লাইন অন ফায়ার: সিজফায়ার ভায়োলেসেন্স অ্যান্ড ইন্ডিয়া-পাকিস্তান এসকেলেশন ডায়নামিক্স’-এই শিরোনামে বই লিখেছেন হ্যাপিমন জ্যাকব।

সেই বইয়ে তিনি লিখেছেন, ‘এই বিষয়টা বিস্ময়কর যে পরমাণু শক্তিধর দুই দেশে কীভাবে নিয়মিত ১০৫ মিমি মর্টার, ১৩০ ও ১৫৫ মিমি আর্টিলারি গান এবং অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইলের মতো উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রের ব্যবহার করে, যার ফলে বেসামরিক ও সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং এটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ তদন্ত ও নীতিগত মনোযোগকে এড়িয়ে গিয়েছে।’

যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের নেপথ্যে দু’টো প্রধান বিষয় চিহ্নিত করেছেন হ্যাপিমন জ্যাকব। এরমধ্যে প্রথমত, ভারত শাসিত কাশ্মীরে ‘সন্ত্রাসী অনুপ্রবেশের সুবিধার জন্য পাকিস্তান প্রায়শই কভার ফায়ার ব্যবহার করে, যা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারতীয় শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের সাক্ষী থেকেছে।’

অন্যদিকে, পাকিস্তান পাল্টা অভিযোগ করে আসছে, ‘ভারত বিনা প্ররোচনায় বেসামরিক এলাকায় গুলি চালাচ্ছে।’

তার যুক্তি হচ্ছে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন ‘উচ্চ স্তরের রাজনৈতিক কৌশলের’ ফল নয় বরং স্থানীয় সামরিক ‘গতিশীলতার ফলাফল।’

জেকবের মতে, ‘অস্থিরতা’ প্রায়শই ফিল্ড কমান্ডারদের দিয়েই শুরু হয়। এক্ষেত্রে কখনও কখনও কেন্দ্রীয় অনুমোদন নেওয়া হয়, আবার প্রায়শই কেন্দ্রীয় অনুমোদন ছাড়াই ঘটে।

তিনি এই ধারণাকেও ‘চ্যালেঞ্জ’ করেন যে , পাকিস্তান সেনাবাহিনী একাই যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে। বরং এই ‘জটিলতার’ নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় সামরিক অপরিহার্যতা এবং দুই দেশেরই সীমান্ত বাহিনীকে দেওয়া স্বায়ত্তশাসনের অধিকার- এই দুই বিষয়ের এক ‘জটিল মিশ্রণ’।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, প্রায় দুই দশক আগে ‘স্থগিত করা’ একটা ধারণাকে পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে এবং সেই ধারণা হলো নিয়ন্ত্রণ রেখাকে একটা আনুষ্ঠানিক এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমান্তে পরিণত করা।

অনেকে আবার জোর দিয়ে বলেছেন, এই সম্ভাবনা কখনই ‘বাস্তবসম্মত ছিল না’ – এবং তা ‘এখনও হতে পারে না।’

এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক সুমন্ত্র বোস বলেছেন, ‘ধারণাটা একেবারে অসম্ভব এবং ডেড এন্ডে এসে পৌঁছেছে (এগোনোর কোনও জায়গা নেই এমন পরিস্থিতি বোঝাতে)। কয়েক দশক ধরে ভারতীয় মানচিত্রে জম্মু ও কাশ্মীরের পূর্বতন দেশীয় রাজ্যের পুরোটাই ভারতের অংশ বলে দেখানো হয়েছে।’

সুমন্ত্রে বোসের ভাষ্য- ‘পাকিস্তানের জন্য, এলওসিকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের অংশ করার অর্থ দাঁড়াবে কাশ্মীর বিরোধের নিষ্পত্তি করা ফেলা যা পাকিস্তানের দিক থেকে ভারতের পছন্দ মতো শর্তের অধীনে ‘হলি গ্রেলের’ সমতুল্য (এমন একটা বিষয় যা লাভ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা রয়েছে কিন্তু তা পাওয়া সহজ নয়)।’

অধ্যাপক বোস ২০০৩ সালে প্রকাশিত তার বই, ‘কাশ্মীর: রুটস অফ কনফ্লিক্ট, পাথস টু পিস’-এ লিখেছেন, ‘কাশ্মীর সমঝোতার জন্য নিয়ন্ত্রণ রেখাকে কাঁটাতার, বাঙ্কার, পরিখা ও শত্রুভাবাপন্ন সেনাবাহিনীর লোহার পর্দার পরিবর্তে কাপড়ের পর্দায় রূপান্তরিত করা প্রয়োজন। বাস্তব রাজনীতির নির্দেশ মেনে যে সীমানা স্থায়ী হবে (সম্ভবত অন্য নামে), এবং তা বিলুপ্ত না করেই অতিক্রম করতে হবে।’

প্রসঙ্গত, ২০০৪ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে, নিয়ন্ত্রণ রেখাকে ‘সফ্ট বর্ডারে’ রূপান্তরিত করার বিষয়টা কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের শান্তি প্রক্রিয়ার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যদিও শেষপর্যন্ত তেমনটা হয়নি। আন্তর্জাতিক সীমান্তের প্রেক্ষাপটে ‘সফ্ট বর্ডার’ বলতে এমন এক সীমান্ত যেখানে মানুষ এবং পণ্যের যাতায়াতের ক্ষেত্রে ন্যূনতম তল্লাশি হবে।

বর্তমানে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে আবার উত্তেজনা দেখা গেছে এবং এই পরিস্থিতি যারা ওই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য ‘সহিংসতা এবং অনিশ্চয়তার চক্রকে’ ফিরিয়ে এনেছে।

পাকিস্তান শাসিত কাশ্মীরে অবস্থিত হোটেলের এক কর্মচারী সাম্প্রতিক সংঘর্ষের সময় বলেছিলেন, ‘এরপর কী হবে তা আপনি জানেন না। নিয়ন্ত্রণ রেখার দিকে মুখ করে আজ রাতে কেউই ঘুমাতে চায় না।’

The short URL of the present article is: https://www.nirapadnews.com/espk
Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ

আল কোরআন ও আল হাদিস

- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন