এস এম আজাদ হোসেন: এপ্রিল মাস। পহেলা বৈশাখের উৎসব থেকে শুরু করে স্বাধীনতার স্বপ্নপূরণের নানা আলাপ চলেছে চারদিকে। কিন্তু সেই মাসেই বাংলাদেশে ৩৩২ নারী ও মেয়েশিশু ধর্ষণ ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন-এমন এক পরিসংখ্যান সামনে এনেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
এই সংখ্যা শুধু সংখ্যা নয়, প্রতিটি নামহীন ‘সংখ্যা’র পেছনে আছে একটি ছিন্নভিন্ন স্বপ্ন, লুণ্ঠিত আত্মসম্মান এবং এক অপার বিচারহীনতার ইতিহাস।
‘সেফ বাংলাদেশ’: শুধু স্লোগানে, বাস্তবে নারীর জন্য হাহাকার
১১১ জন ধর্ষিত, ২৪ জন গ্যাং রেপের শিকার, ৫ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা, এবং ২৯ জনের উপর ধর্ষণচেষ্টা-এই সংখ্যাগুলো দেখে কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না, এই দেশই নারীর ক্ষমতায়ন, এসডিজি আর ডিজিটাল নিরাপত্তার গল্প বলে বেড়ায়।
তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের নারীর জন্য ঘর, পথ, কর্মস্থল-সব জায়গা এখন ‘অসম্ভবের ঝুঁকি’। এমনকি গৃহকর্মীর জীবনও নিরাপদ নয়, যাদের দুইজন এই মাসেই নির্মমভাবে হত্যা হয়েছেন।
‘নির্যাতনের মরচে লেগেছে রাষ্ট্রীয় নীরবতায়’
৭০টি খুন। ধর্ষণপূর্ব হত্যা, যৌতুক-জনিত হত্যা, রহস্যজনক মৃত্যু, আত্মহত্যা-বিভিন্ন নামে মৃত্যু হলেও মূল ট্র্যাজেডি একটাই: একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘস্থায়ী নীরবতা ও অবহেলা।
২৪ জনের রহস্যজনক মৃত্যু আর ২৪ জনের আত্মহত্যা-এই দুটি পরিসংখ্যান একটিই প্রশ্ন তোলে: আমরা কি শুধু পরিসংখ্যানে নারীর জীবন গণনা করবো? নাকি তাকে ঘিরে গড়ে তোলা সামাজিক কাঠামো ভাঙবো?
দলবদ্ধ ধর্ষণ ও সাইবার অপরাধ: সহিংসতার ‘নতুন প্রযুক্তি’
এই প্রতিবেদনের ভয়াবহ দিকগুলোর একটি হলো, ২৪ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এটি শুধু শারীরিক সহিংসতা নয়, বরং সমাজের ‘পিতৃতান্ত্রিক সহিংসতা’র সম্মিলিত থাবা।
এদিকে সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন একজন নারী। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, সহিংসতা শুধু গলিতে-ঘরে নয়, এখন স্ক্রিনের মধ্যেও নারীর শ্বাসরুদ্ধ করা বাস্তবতা উপস্থিত।
‘আত্মহত্যা নয়, এটি প্ররোচিত মৃত্যু’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তত দুইজন ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন। অথচ গণমাধ্যমের ভাষায় এগুলো হয় ‘পরিণতির দুঃখজনক ট্রাজেডি’। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো-এই আত্মহত্যা নয়, এটি সামাজিক সহানুভূতির ব্যর্থতা এবং বিচারহীনতার ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়া মৃত্যু।
রাষ্ট্র কী করে? সংবাদ পড়ে চুপ থাকে
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে, মিডিয়া রিপোর্ট করে, কিছুদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ-তারপর নীরবতা। আবার পরবর্তী মাসের নতুন পরিসংখ্যান, নতুন ট্র্যাজেডি।
আইনি কাঠামো, পুলিশি তদন্ত, বিচার বিভাগ-সব আছে, কিন্তু সব যেন কাচের দেয়ালের পেছনে দাঁড়িয়ে শুধু দেখে।
নারীর লাশ আর রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের সমান্তরাল যাত্রা
এই প্রতিবেদনের ভেতর দিয়ে স্পষ্ট হলো-বাংলাদেশে উন্নয়ন হতে পারে, মেট্রোরেল ছুটতে পারে,পুঁজিবাজার চাঙ্গা হতে পারে, কিন্তু নারীর জীবন এখনো টালমাটাল।
শুধু অপরাধীদের বিচার নয়, পুরো রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকারে ব্যর্থতার হিসাবও এই প্রতিবেদনে অদৃশ্যভাবে উঠে এসেছে।
সংখ্যার বাইরে প্রতিবাদের ভাষা দরকার
১১১ ধর্ষণ, ৭০ খুন-এই সংখ্যা মনে রাখার জন্য নয়, প্রতিবাদ গড়ার জন্য। সংবাদপত্রের ভাঁজে নয়, আইনের পাতায় প্রতিফলনের জন্য। রাষ্ট্রের মঞ্চে এ নিয়ে জবাবদিহি চাইতে হবে-না হলে প্রতিটি নতুন মাস, একটি নতুন মৃত্যুর মাস হিসেবেই ইতিহাসে লেখা থাকবে।