খাবার শুধু পেটে গেলেই শরীর পুষ্টি পায় না শুরুটা হয় মুখ থেকেই। প্রতিটি কণা ভালোভাবে চিবিয়ে খাওয়া শুধু হজমশক্তি বাড়ায় না, বরং গ্যাস্ট্রিক, অ্যাসিডিটি, ওজন বৃদ্ধি থেকে শুরু করে নানা স্বাস্থ্যসমস্যা দূরে রাখতে সাহায্য করে।
গবেষকরা বলেন, অন্তত ৩২ বার চিবিয়ে খাওয়া খাবারের পুষ্টিগুণ সঠিকভাবে শোষণে সহায়ক এবং পেটের উপর চাপ কমায়। তাড়াহুড়ো করে গিলে না খেয়ে ধীরে ধীরে চিবিয়ে খাওয়া হতে পারে সুস্থ জীবনের সহজ কিন্তু কার্যকর উপায়। যখন আপনি খাবার চিবোন, তখন তা ছোট ছোট টুকরোতে ভেঙে যায়, যা সহজে হজম হয়। লালারসের সঙ্গে মিশে এই খাবার শরীরকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে। হেলথলাইনের প্রতিবেদনে চিকিৎসকরা সঠিক নিয়মে খাবার চিবানোর বিষয়ে বিস্তারিত জানিয়েছেম।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, গড়ে একেক কামড় খাবার প্রায় ৩২ বার চিবিয়ে গিলে ফেলা উচিত। নরম বা পানি-সমৃদ্ধ খাবার তুলনামূলক কমবার চিবানো লাগে, যেমন তরমুজ ১০–১৫ বার চিবালেই হয়। আবার স্টেক বা বাদামের মতো শক্ত খাবার ৪০ বার পর্যন্ত চিবাতে হতে পারে। লক্ষ্য হলো খাবারের টেক্সচার বা গঠন সম্পূর্ণ ভেঙে যাওয়া।
চিবানোর উপকারিতা
চিবানো শুধু খাবার গেলার প্রস্তুতি নয়, বরং পুরো হজম প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। মুখে খাবার লালা ও দাঁতের সাহায্যে ভেঙে মিশে যায়, তারপর তা খাদ্যনালী হয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে। সেখান থেকে এনজাইম মিশে খাবারকে আরও ভেঙে দেয়, যাতে শরীর শক্তি হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এরপর ক্ষুদ্রান্ত্রে গিয়ে খাবার থেকে পুষ্টি শোষিত হয় এবং অবশিষ্ট বর্জ্য বৃহদান্ত্রে গিয়ে শরীর থেকে বের হয়ে যায়।
যারা খাবার ভালোভাবে চিবিয়ে খান না, তারা হজমজনিত নানা সমস্যায় ভুগতে পারেন। এছাড়া চিবিয়ে না খাওয়ার ফলে শ্বাসরোধ, অপুষ্টি, পানিশূন্যতা, এমনকি খাবারের প্রতি অরুচিও হতে পারে। দ্রুত খেলে সাধারণত বেশি খাওয়া হয়ে যায়। ধীরে ও বারবার চিবিয়ে খেলে খাদ্যগ্রহণের পরিমাণ কমে যায় এবং দীর্ঘ সময় পেট ভরা অনুভূত হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ধীরে খায়, তারা কম খান এবং পরে মিষ্টি জাতীয় স্ন্যাকস খাওয়ার প্রবণতাও কমে যায়।
যেভাবে সঠিক নিয়মে খাবার চিবাতে হবে
চামচ বা কাঁটাচামচে বেশি খাবার নেয়া যাবে না। বরং অল্প পরিমাণ খাবার মুখ নিয়ে খেতে হবে।
মুখ বন্ধ রেখে খাবার চিবাবেন, জিভ দিয়ে একপাশ থেকে অন্যপাশে খাবার সরাবেন।
খাবারের ধরণ অনুযায়ী প্রায় ৩২ বার (বা প্রয়োজন অনুসারে বেশি/কম) চিবাবেন।
খাবারের টেক্সচার হারালে গিলে ফেলুন।
চিবিয়ে না খাওয়ার ক্ষতিকর দিক
খাবার পুরোপুরি চিবানো না হলে শরীরের হজম প্রক্রিয়ার অন্যান্য অংশগুলো ব্যাহত হয়ে যায়। মুখে পর্যাপ্তভাবে চিবানো না হলে খাবারের বড় টুকরোগুলো পাকস্থলীতে যায়, যা পেট এবং অন্ত্রকে হজমের জন্য অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে। ফলে শরীর পর্যাপ্ত পরিমাণে এনজাইম উৎপাদন করতে পারে না, যা খাবারকে পুরোপুরি ভেঙে পুষ্টি শোষণ করতে সাহায্য করে। পর্যাপ্ত চিবানো না হলে নীচের সমস্যাগুলো দেখা দিতে পারে:
পেট ফুলে যাওয়া: খাবার ঠিকভাবে হজম না হওয়ায় গ্যাস জমতে থাকে, যা পেটে ফোলা এবং অস্বস্তি তৈরি করে।
ডায়রিয়া: খাবারের বড় টুকরো দ্রুত অন্ত্রে গেলে শরীর যথাযথভাবে পানি শোষণ করতে পারে না, যার ফলে ডায়রিয়া হতে পারে।
হিয়ার্টবার্ন: খাবারের বড় টুকরো পাকস্থলীতে চাপ বাড়ায়, যা অ্যাসিড উৎপাদন বাড়িয়ে হিয়ার্টবার্ন বা জ্বালা তৈরি করতে পারে।
অ্যাসিড রিফ্লাক্স: পাকস্থলীর অ্যাসিড খাবারের সঙ্গে সঠিকভাবে মিশে না গেলে তা গলায় ফিরে আসতে পারে, যা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সমস্যা তৈরি করে।
পেটের কাঁপা বা ক্র্যাম্প: কম চিবানো খাবার পাকস্থলী ও অন্ত্রকে অতিরিক্ত কাজ করতে বাধ্য করে, যার ফলে পেটে ব্যথা বা কাঁপা অনুভূত হতে পারে।
বমি বমি ভাব: খাবারের সঠিকভাবে হজম না হওয়ার কারণে শরীর বমি বমি ভাব অনুভব করতে পারে।
মাথাব্যথা: অপর্যাপ্ত পুষ্টি শোষণ বা হজমজনিত সমস্যা কখনও কখনও মাথাব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।
ত্বকের সমস্যা: পুষ্টি শোষণের অভাবে ত্বকে খসখসে ভাব, একজিমা বা অন্যান্য চামড়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
চড়চড়ে মেজাজ: খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত পুষ্টি না পাওয়ায় শরীর এবং মস্তিষ্কে এনার্জি কমে যায়, যা চড়চড়ে মেজাজের কারণ হতে পারে।
পুষ্টিহীনতা: যদি খাবার পুরোপুরি চিবানো না হয়, শরীর পর্যাপ্ত ভিটামিন ও খনিজ শোষণ করতে পারে না, ফলে পুষ্টিহীনতা দেখা দেয়।
খাবার খাওয়ার বাড়তি টিপস
খাবারের পরপরই কফি খাবেন না।
খাবারের পর ফল বা অতিরিক্ত মিষ্টি এড়িয়ে চলুন।
খাবারের পর ভারী ব্যায়াম করবেন না।
সাওয়ারক্রাট বা আচারজাতীয় ফারমেন্টেড খাবার খান।
কাঁচা বা হালকা সেদ্ধ সবজি খান।
খাবারের পর হালকা হাঁটুন।
প্রয়োজন হলে প্রোবায়োটিক গ্রহণ করুন।
সুস্থ হজম মুখ থেকে শুরু হয়। খাবার ধীরে ও ভালোভাবে চিবিয়ে খেলে শুধু হজমই ভালো হয় না, বরং খাবারের স্বাদ ও উপকারিতাও বাড়ে। ৩২ বার চিবানোর অভ্যাস আপনাকে কম খেতে, ভালোভাবে পুষ্টি গ্রহণ করতে এবং খাওয়ার অভিজ্ঞতা উপভোগ করতে সাহায্য করবে।