রসুন এক প্রকার সুপরিচিত রান্নার উপাদান যা বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন খাবারে ব্যবহৃত হয়। এর তীব্র গন্ধ ও স্বাদ রান্নায় এক বিশেষতা আনে। তবে রসুন শুধু স্বাদ বৃদ্ধির জন্যই নয়, এর অসাধারণ স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্যও বহুকাল ধরে পরিচিত। প্রাচীন মিশর, গ্রীস, রোম ও চীনে রসুন ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আধুনিক বিজ্ঞানও এখন প্রমাণ করেছে, রসুনের অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা আছে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো থেকে শুরু করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত – রসুন একাধিক উপকারে আসে। এটি প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় রাখলে অনেক উপকার পাওয়া যায়। তাই চলুন জেনে নেয়া যাক রসুনের উপকারিতা সম্পর্কে –
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
রসুনের সবচেয়ে পরিচিত গুণ হলো এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে থাকা অ্যালিসিন নামক যৌগ ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের বিরুদ্ধে কাজ করে। নিয়মিত রসুন খেলে সাধারণ ঠান্ডা, সর্দি বা ফ্লুয়ের মতো অসুখ কম হয় এবং দ্রুত সেরেও যায়।
২. রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন হৃদরোগ ও স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ। রসুন রক্তনালিকে প্রশস্ত করে এবং রক্ত প্রবাহ বাড়ায়, ফলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। অনেক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, রসুনের নির্যাস নিয়মিত খেলে উচ্চ রক্তচাপ অনেকটাই কমে যায়।
৩. হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী
রসুন হৃদরোগ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এটি শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল এলডিএল কমাতে সাহায্য করে এবং ভালো কোলেস্টেরল এইচডিএল বজায় রাখে। পাশাপাশি রক্ত জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক প্রতিরোধে সাহায্য করে। এই কারণে রসুনকে হৃদরোগের প্রাকৃতিক প্রতিকার বলা হয়।
৪. অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে
রসুনে প্রচুর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে যা শরীরকে ক্ষতিকর ফ্রি র্যাডিকেল থেকে রক্ষা করে। এই ফ্রি র্যাডিকেল শরীরের কোষ নষ্ট করে এবং বার্ধক্যজনিত নানা রোগ সৃষ্টি করে। রসুন কোষগুলোকে সুরক্ষা দেয় এবং মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা ধরে রাখতে সহায়তা করে।
৫. ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক
গবেষণায় দেখা গেছে, রসুন পাকস্থলী, কোলন এবং খাদ্যনালীর ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। এতে থাকা সালফার যৌগ ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি ধীর করে এবং ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদানগুলো প্রতিহত করে। রসুন শরীরের ডিএনএ গঠনে সহায়তা করে এবং প্রদাহ কমায়, যা ক্যানসার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।
৬. হজম ও দেহ পরিশোধনে সহায়তা করে
রসুন হজমে সাহায্য করে এবং পাচক রস তৈরিতে সাহায্য করে। এটি গ্যাস, অম্বলতা এবং বমি ভাব কমাতে কার্যকর। এছাড়া, রসুন লিভারকে সক্রিয় করে এবং শরীরের টক্সিন দূর করতে সাহায্য করে, যা দেহকে ভেতর থেকে পরিষ্কার রাখে।
৭. ত্বক ও চুলের জন্য উপকারী
রসুনের জীবাণুনাশক বৈশিষ্ট্য ত্বকের নানা সমস্যায় উপকারী। যেমন ব্রণ বা ফাঙ্গাল ইনফেকশনে রসুনের রস ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়। তাছাড়া, এতে থাকা সালফার কোলাজেন উৎপাদনে সাহায্য করে, যা ত্বককে টানটান ও সতেজ রাখে। চুলের গোড়া শক্ত করে ও চুল পড়া রোধ করতেও রসুন উপকারী।
৮. ওজন কমাতে সহায়ক
রসুন শরীরের বিপাকক্রিয়া বাড়াতে এবং চর্বি কমাতে সাহায্য করতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, এটি ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণ করে এবং অতিরিক্ত খাওয়ার অভ্যাস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যদিও রসুন একা ওজন কমাতে যথেষ্ট নয়, তবে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে রসুন খাওয়া ওজন কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৯. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
রসুন রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে। এটি ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়ায় এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী হতে পারে। নিয়মিত রসুন খেলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সহজ হতে পারে।
১০. প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক ও অ্যান্টিভাইরাল
রসুনের জীবাণুনাশক গুণাবলি বহু প্রাচীনকাল থেকে রোগ সারাতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি প্রাকৃতিক অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে কাজ করে এবং অনেক ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ঠান্ডা, গলা ব্যথা বা হালকা সংক্রমণে রসুন বেশ কার্যকর।
যেভাবে খাবেন
রসুন কাঁচা, রান্না করা বা সাপ্লিমেন্ট হিসেবে খাওয়া যায়। কাঁচা রসুনে অ্যালিসিন সবচেয়ে বেশি থাকে। তবে কাঁচা রসুনের গন্ধ ও ঝাঁঝ অনেকের জন্য অসহ্য হতে পারে। তাই রান্নায় রসুন ব্যবহার করাও উপকারী। রসুনের তেল বা গুঁড়াও ব্যবহার করা যায়, তবে কাঁচা রসুন খাওয়া সবচেয়ে ভালো।
তবে রসুন খাওয়া অধিকাংশ মানুষের জন্য নিরাপদ হলেও অতিরিক্ত খেলে পেটের গ্যাস, গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস বা অ্যালার্জির সমস্যা হতে পারে। তাই কারও স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলে বা ওষুধ খেলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
রসুন ছোট হলেও এর গুণ অনেক বড়। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হৃদরোগ ও ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে এবং শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা বজায় রাখে। প্রতিদিন খাদ্যতালিকায় রসুন অন্তর্ভুক্ত করলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে। তাই রসুনকে এককথায় প্রাকৃতিক ওষুধ বলা যায়।