নিঃসঙ্গতার সঙ্গী হিসেবে পোষা প্রাণী পালন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশ জনপ্রিয়। আমাদের দেশেও পোষা প্রাণী হিসেবে বিড়াল ও কুকুর পালনের প্রবণতা দিনদিন বাড়ছে। ফলে পোষাপ্রাণী বিষয়ক নানা ধরনের ক্লাব গড়ে উঠেছে। অনেকে নিজেদের প্রিয় ব্যক্তির নাম অনুসারে প্রাণীর নামকরণও করছেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, পোষা প্রাণীর সঙ্গে সময় কাটানোর ফলে মানসিক চাপ কমে, হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস পায় এবং স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধিসহ নানা উপকার পাওয়া যায়। তবে অসর্তকতার কারণে পোষা প্রাণীর মাধ্যমে মানুষের শরীরে বাসা বাঁধতে পারে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু, যা স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আজ বৃহস্পতিবার এই বিষয়ে আমাদের সময়ের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সিদ্দিকুর রহমান।
তিনি জানান, পোষা প্রাণী পালনে যেমন ভালো দিক রয়েছে, তেমনি কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। বর্তমান পৃথিবীতে উদ্ভাবিত অধিকাংশ নতুন রোগই জুনোটিক, অর্থাৎ প্রাণী থেকে মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়। পোষা প্রাণীর মাধ্যমেও নানা ধরনের রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু মানুষের দেহে প্রবেশ করতে পারে। যেমন:
১. চর্মরোগ
সাধারণত মাইকোস্পোরাম গণের ছত্রাকের কারণে পোষা প্রাণীর দেহে চর্মরোগ দেখা যায়, যা ‘দাদ’ বা ‘রিংওয়ার্ম’ নামেও পরিচিত। যদি কোনো ব্যক্তি এই রোগে আক্রান্ত প্রাণীর সরাসরি সংস্পর্শে আসে অথবা ওই প্রাণী ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিসপত্রের সংস্পর্শে আসে, তাহলে এ রোগটি মানুষের দেহে ছড়াতে পারে। রোগটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় যাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম, যেমন শিশু ও বয়স্কদের দেহে সহজেই সংক্রমিত হতে পারে।
২. ডায়রিয়া
ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর এবং ক্রিপ্টোস্পোরিডিয়াম গণের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত পোষা প্রাণী মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সাধারণত আক্রান্ত প্রাণীর মলের সরাসরি সংস্পর্শে অথবা সেই মলের মাধ্যমে খাদ্যের উৎস দূষিত হলে রোগটি ছড়াতে পারে।
৩. গর্ভপাত
টক্সোপ্লাজমা গণের ধরনের প্রোটোজোয়ার কারণে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত হয়। এই জীবাণু পোষা প্রাণীর পরিপাকতন্ত্রে বসবাস করে এবং মলের মাধ্যমে ছড়ায়। যদি কোনো গর্ভবতী মহিলা আক্রান্ত প্রাণীর মলের সরাসরি সংস্পর্শে আসে অথবা মলের মাধ্যমে খাদ্যদ্রব্য দূষিত হয়, তাহলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৪. আচঁড় জ্বর
এই সংক্রামক রোগটি বার্টোনেলা হেনসেলে নামক ব্যাকটেরিয়ার কারণে হয়ে থাকে। এটি পোষা প্রাণীর নখ ও লালায় থাকতে পারে। এই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত পোষা প্রাণী যদি মানুষকে আচঁড় বা কামড় দেয়, তবে এই রোগ হতে পারে। তবে আচঁড়ে যদি রক্তপাত না হয়, তাহলে সাধারণত সমস্যা হয় না। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জ্বর হয় এবং লিম্ফ নোড ফুলে যায়।
৫. জলাতঙ্ক
এই রোগটি র্যাবিস ভাইরাসের মাধ্যমে হয়ে থাকে, যা মানুষের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং নিগরি বডি তৈরি করে। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর ঝুঁকি শতভাগ। সাধারণত আক্রান্ত কুকুর বা বিড়ালের কামড়ের মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। কামড়ে রক্তপাত হলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়ে যায়।
৬. গোলকৃমি
পোষাপ্রাণীর দেহে নানা ধরনের গোলকৃমিথাকতে পারে। যদি কোনো ব্যক্তি পোষা প্রাণীর মল বা বর্জ্যের সংস্পর্শে আসে, তাহলে ওই কৃমিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
৭. ব্রুসেলোসিস
ব্রুসেলা গণের ব্যাকটেরিয়ার কারণে পোষা প্রাণীর গর্ভপাত হয় । এই জীবাণু আক্রান্ত প্রাণীর দেহ থেকে কোনো ব্যক্তির প্রাকৃতিক রন্ধ্র বা কাটা জায়গা দিয়ে প্রবেশ করলে সংক্রমণ ঘটতে পারে। এই জীবাণুতে নারীরা আক্রান্ত হলে গর্ভপাত এবং পুরুষদের ক্ষেত্রে টেস্টিসের প্রদাহ ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়।
৮. টিউবারকুলোসিস
মাইকোব্যাকটেরিয়াম গণের জীবাণুর সংক্রমণে পোষা প্রাণী টিউবারকুলোসিস বা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়। যদি কোনো ব্যক্তি আক্রান্ত প্রাণীর সংস্পর্শে আসে বা শরীরের কাটা স্থানের মাধ্যমে জীবাণু প্রবেশ করে, তাহলে তার সংক্রমণ ঘটতে পারে। তবে প্রাণী থেকে মানুষে এই রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা বিরল।
৯. অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স জীবাণু
পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনে ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে তাদের দেহে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স জীবাণু তৈরি হয়, যা পরে মানুষের দেহে প্রবেশ করে নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।
অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেন, কিছু সচেতনতা মেনে চললেই পোষা প্রাণীর মাধ্যমে ছড়ানো রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যেমন:
১. পোষা প্রাণীকে নিয়মিত ভ্যাকসিন ও কৃমিনাশক দিতে হবে।
২. চর্মরোগ (দাদ) দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসা নিতে হবে।
৩. ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত প্রাণীকে খালি হাতে স্পর্শ করা যাবে না।
৪. অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৫. পোষা প্রাণীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সময় গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।
৬. প্রাণীর সংস্পর্শে আসার পর ভালোভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
৭. পোষা প্রাণীকে প্রতিদিন গোসল করাতে হবে এবং বাড়ি পরিষ্কার রাখতে হবে।