আপনি কি জানেন যে, বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য আনুযায়ী প্রায় ৮০% শিশু ভিটামিন-ডি এর অভাবে ভুগছে? একটি পৃথক গবেষণায় দেখা গেছে যে, গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ১-৬ মাস বয়সী শিশুদের এক-তৃতীয়াংশই ভিটামিন-ডি এর অভাবে ভুগছে। অথচ ১৮ মাস বয়স অব্দি শিশুর বিকাশ ও বৃদ্ধিতে ভিটামিন-ডি এর অবদান আছে।
ভিটামিন-ডি হাড়, দাঁত ও পেশি শক্ত রাখার পাশাপাশি শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি মূলত শরীরকে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস শোষণে সাহায্য করে, যা হাড়ের গঠন ও শক্তির জন্য প্রয়োজনীয়। ভিটামিন-ডি এর ঘাটতিতে হাড় দুর্বল হয়ে ভেঙে যেতে পারে বা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে রিকেটস নামক রোগ হতে পারে। এটি শুধু শারীরিক নয়, মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গেও জড়িত। এর অভাবে বিষণ্নতা, ক্লান্তি ও মনমরা ভাব দেখা যায়। এছাড়াও, ভিটামিন-ডি ইনসুলিন নিঃসরণে সাহায্য করে বলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণেও সহায়ক।
অর্থাৎ একটি শিশুর সঠিকভাবে বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে তার সারাজীবনই যথেষ্ট পরিমাণে ভিটামিন-ডি প্রয়োজন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই অন্যান্য ভিটামিনের বিষয়ে সচেতন হলেও ভিটামিন-ডি এর বিষয়ে শুধুমাত্র সূর্যালোকের ওপর ভরসা করে থেকে যান। কিন্তু বিভিন্ন খাবার থেকেও ভিটামিন-ডি পাওয়া সম্ভব। যেমন, ডিমের কুসুম, চর্বিযুক্ত মাছ, যকৃৎ, মাশরুম, ফোর্টিফায়েড দুধ ও দই।
এই ভিটামিনের অভাবে শিশুর হার নরম থেকে যেতে পারে। সেই সঙ্গে প্রাপ্তবয়স্কদেরও দেখা দিতে পারে নানা লক্ষণ। জেনে নিন ভিটামিন-ডি এর অভাবে শরীরে কী কী লক্ষণ দেখা দিতে পারে-
মানসিক স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব:
১. বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন
ভিটামিন–ডি মস্তিষ্কে সেরোটোনিন নামক ‘হ্যাপি হরমোন’ তৈরিতে সাহায্য করে। এর ঘাটতিতে মেজাজ খারাপ থাকে, মন খারাপ লাগে, এবং হতাশার অনুভূতি আসে। দীর্ঘ সময় ধরে ডিপ্রেশন চলতে থাকলে সেটি মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
২. উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা
ভিটামিন-ডি কমে গেলে নিত্যদিনের ছোট ছোট বিষয়েও ভয়, চিন্তা বা আতঙ্কের অনুভূতি জাগে। এতে ঘুমের সমস্যা ও ঘন ঘন প্যানিক অ্যাটাকও দেখা দিতে পারে।
৩. মনোযোগের ঘাটতি ও স্মৃতিভ্রংশ
ভিটামিন-ডি এর অভাবে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালন ও কোষের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে, যার ফলে দেখা দিতে পারে ধারণশক্তি ও স্মৃতিশক্তি হ্রাস।
৪. ঘুমের সমস্যা
রাত জেগে থাকা, ঘন ঘন জেগে যাওয়া বা সকালবেলা ক্লান্তি নিয়ে উঠা – এসবের পেছনেও ভিটামিন-ডি ঘাটতি দায়ী হতে পারে।
শারীরিক স্বাস্থ্যে ওপর প্রভাব:
১. হাড় বেঁকে যাওয়া বা দুর্বল হয়ে যাওয়া
শিশুদের ক্ষেত্রে ভিটামিন-ডি এর দীর্ঘমেয়াদি ঘাটতিতে পায়ের হাড় ধনুকের মতো বেঁকে যেতে পারে, যাকে রিকেটস বলা হয়। বড়দের ক্ষেত্রে হাড় ভঙ্গুর ও দুর্বল হয়ে পড়ে, যেকোনো ধাক্কাতেই ফ্র্যাকচার হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়।
২. গাঁটে ব্যথা ও বাতের মতো উপসর্গ
হাড়ের পাশাপাশি শরীরের জয়েন্ট বা গাঁটগুলোতেও ব্যথা অনুভূত হতে পারে। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে বাতের সমস্যা বেড়ে যায়। হাঁটলে বা সিঁড়ি উঠলেই ব্যথা দেখা দিতে পারে।
৩. থাইরয়েড ও মেরুদণ্ডের সমস্যা
ভিটামিন-ডি এর ঘাটতি শরীরের হরমোন ব্যালেন্সেও প্রভাব ফেলে, যার ফলে থাইরয়েডের সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেকের আবার মেরুদণ্ডে ব্যথা, কোমর বা ঘাড়ে টান টান অনুভব হয়।
৪. দাঁত পড়ে যাওয়া ও ইনফেকশন
দাঁতের মাড়ি দুর্বল হয়ে দাঁত অকালেই পড়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে দাঁত ও মুখগহ্বরে বারবার ইনফেকশন দেখা দিতে পারে।
৫. বারবার অসুস্থ হওয়া, ঘা শুকাতে দেরি
ভিটামিন-ডি শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় রাখে। এর অভাবে শরীর সহজে রোগ ধরে, এবং সামান্য কাটাছেঁড়াও শুকাতে অনেক সময় নেয়।
৬. ক্লান্তিভাব ও শারীরিক অলসতা
ভিটামিন-ডি কমে গেলে সব সময় ঝিমুনি, ক্লান্তিভাব এবং কিছু না করেও শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। ঘুম ঠিক মতো হলেও শরীর চাঙ্গা লাগে না।
৭. অতিরিক্ত চুল পড়া
চুল পড়ে যাওয়া শুধু প্রোটিন বা হরমোনের কারণে হয় না, ভিটামিন-ডি কম হলেও চুল পাতলা হয়ে যেতে পারে এবং মাথার তালুতে অস্বস্তি দেখা দেয়।
৮. শরীরে ম্যাজম্যাজে ভাব ও হাত-পায়ের ব্যথা
অনেকেই বলেন, ‘শরীরটা ঝিম ঝিম করছে’, ‘হাত-পা অবশ লাগে’ – এগুলোও হতে পারে ভিটামিন-ডি ঘাটতির প্রাথমিক লক্ষণ।
৯. হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া
যথেষ্ট খাবার খেয়েও হঠাৎ করে ওজন কমে গেলে, এবং সেই সঙ্গে দুর্বলতা অনুভূত হলে, একে হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়। ভিটামিন-ডি অভাবজনিত হরমোন ভারসাম্যহীনতার কারণে এমনটা হতে পারে।
কার শরীরে কতটুকু ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন তা নির্ভর করে বয়স অনুযায়ী। পূর্ণ বয়স্ক মানুষের দৈনিক ৬০০ ইউনিট ভিটামিন ডি ও ১০০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যালসিয়াম এর চাহিদা থাকে। অথচ বর্তমান শহুরে জীবনে না আমরা সূর্যের আলোতে বেশিক্ষণ থাকি, না খাবার থেকে পাওয়া পুষ্টির দিকে তেমন মনোযোগ দেই। ভিটামিন-ডি এমন একটি উপাদান, যা শরীরে পর্যাপ্ত না থাকলে আপনার শরীর অন্যান্য পুষ্টিও ঠিকভাবে শোষণ করতে পারবে না।
তাই প্রতিদিন কিছুটা সময় রোদে থাকার চেষ্টা করুন ও ভিটামিন-ডি সমৃদ্ধ খাবার খান।