সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব যেন জীবন থেমে যাওয়ার নাম। চলার শক্তি হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন অনেকে। ঠিক এই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) আবারও প্রমাণ করলো—মানুষের জন্য কাজ করাই তাদের প্রকৃত ধর্ম।
নিসচা কানাডা শাখার অর্থায়নে এবং নিসচা উত্তরা শাখার সার্বিক সহযোগিতায় বগুড়ায় ৭ জন সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হওয়া ব্যক্তির মাঝে হুইলচেয়ার ও হ্যান্ড ক্রাচ বিতরণ করা হয়। সোমবার দুপুর ৪টায় বগুড়ার মালতিনগর মাটির মসজিদ সংলগ্ন নিরাপদ সড়ক চাই বগুড়া জেলা শাখার অস্থায়ী কার্যালয়ে এ বিতরণ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে নিসচার প্রতিষ্ঠাতা চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সুস্থ্যতায় দোয়া কামনা করা হয়। এরপর সন্মানিত অতিথিদের ফুল দিয়ে বরন করে নেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এস এম আজাদ হোসেন, মহাসচিব, কেন্দ্রীয় কমিটি। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উদয় কুমার শাহা, হাইওয়ে এডিশনাল এসপি, এবং মো. আনোয়ার হোসেন, অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে এস এম আজাদ হোসেন বলেন— “নিসচা শুধু দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কাজ করে না, দুর্ঘটনার শিকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। দেশের প্রতিটি জেলায় এমন মানবিক উদ্যোগ ছড়িয়ে যাবে—এটাই আমাদের স্বপ্ন।”

তিনি আরো বলেন, জীবন কখনও কখনও এমন পরীক্ষা নেয়, যা আমাদের শক্তি, ধৈর্য আর আশার সীমা ছাড়িয়ে যায়। সড়ক দুর্ঘটনায় শরীর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও—আপনার স্বপ্ন, সম্মান, ইচ্ছাশক্তি এবং মানুষ হিসেবে আপনার মূল্য কখনও কমে যায় না। আপনি কোনোদিনই বোঝা নন; আপনি সংগ্রামী, আপনি অনুপ্রেরণা।
আজ যে হুইলচেয়ারটি আপনাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে—এটি কেবল একটি চলার মাধ্যম নয়, এটি নতুন করে পথচলার প্রতীক। এই চেয়ার আপনার স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার একটি ধাপ, আত্মবিশ্বাস জাগানোর একটি সেতু, এবং জীবনের প্রতি আবারো দাঁড়িয়ে যাওয়ার সাহসের পরিচয়।
আমরা জানি, আপনার যন্ত্রণা, আপনার সীমাবদ্ধতা, এবং প্রতিদিনের লড়াইয়ের ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তবুও আপনিই প্রমাণ করছেন—জীবন থেমে যায় না, মানুষ হার মানে না।
আপনারা একা নন—এই সমাজ, এই আন্দোলন, আর এই মানবিক হাত সবসময় আপনাদের সঙ্গে আছে। আমরা চাই, আপনি চলুন, সৃজন করুন, হাসুন, আর প্রমাণ করুন—শরীর ভেঙে যেতে পারে, কিন্তু মন ভাঙা যায় না।
আপনাদের জন্য শুভকামনা, সম্মান এবং অফুরন্ত শক্তির প্রার্থনা। আপনারাই আমাদের সত্যিকারের বীর।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে উদয় কুমার শাহা বলেন— “সড়কে যারা আহত হয়েছেন, তাদের পুনর্বাসন আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেবল সহানুভূতি প্রকাশ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না—সত্যিকারের মানবসেবা হচ্ছে তাদের পাশে দাঁড়ানো, সাহায্য করা এবং আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সহায়তা করা। নিসচার এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে সমাজের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।”

তিনি আরো বলেন, সড়কে অতিরিক্ত গতি, ভুল ওভারটেকিং, ক্লান্ত হয়ে গাড়ি চালানো এবং রোড সাইন অমান্য করা—এসব ছোট ভুলই বড় দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। হাইওয়ে পুলিশ সর্বদা চেষ্টা করে সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে, কিন্তু আইন প্রয়োগের পাশাপাশি চালক এবং পথচারীদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি জরুরি।”
তিনি নিসচারের কাজ সম্পর্কে বলেন, “নিরাপদ সড়ক চাই শুধু দুর্ঘটনার পর সহায়তা করে না; তারা দুর্ঘটনা প্রতিরোধে মাঠে কাজ করে, স্কুল-কলেজে সচেতনতা বৃদ্ধি করে, চালকদের ট্রাফিক আইন শেখায়, এবং সারা বছর জনসচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এমন সংগঠনগুলো আমাদের পুলিশ প্রশাসনের কাজকে আরো সহজ করে দেয়।”
মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, “প্রতিটি হুইলচেয়ার শুধু একটি উপহার নয়—এটি একেকটি মানুষের জীবনকে আবার নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়। সড়ক দুর্ঘটনায় যারা আজ স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, তাদের পাশে দাঁড়ানো নিসচার নৈতিক দায়িত্ব।”
তিনি আরও বলেন, “নিরাপদ সড়ক চাই প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ৩২ বছর ধরে দেশের প্রতিটি জেলায় অবিরামভাবে সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে। আমাদের লক্ষ্য—‘দুর্ঘটনামুক্ত বাংলাদেশ গড়া’। এই যাত্রায় সবার সহযোগিতা ও সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি।”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, নিসচা বগুড়া শাখার উপদেষ্টা মোস্তাফিজার রহমান, সাধারণ সম্পাদক মোঃ রকিবুল ইসলাম সোহাগ, যুগ্ম সম্পাদক মোঃ গোলাম রব্বানী শিপন, দপ্তর সম্পাদক মোঃ ইমরান তালুকদার নিপু, অর্থ সম্পাদক মোঃ জাহিদুর রহমান, কার্য্যনির্বাহী সদস্য ডাঃ এ এস এম রায়হান, এস আই সুমন, আমিন ইসলাম, লতিফুর, ডাঃ আপেল, তারাজুল, সোহাগ মিয়া, মমিন, জান্নাতুল।
উল্লেখ্য, অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও সমন্নয়ক ছিলেন নিসচা কানাডা শাখার সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন, সাধারন সম্পাদক সামি খান, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নাহিদ বেলি, মাসুমা আক্তার ও উত্তরা শাখার এনায়েত উললাহ খনদকার। অনুষ্ঠান এর সার্বিক আয়োজনে ছিলো নিরাপদ সড়ক চাই বগুড়া জেলা শাখা। অনুষ্ঠানে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু মোট ৭জনের মাঝে এই হুইল চেয়ার বিতরণ করা হয়।
