সৈয়দ আবদাল আহমদ: স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেওয়া ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ ভাষণটি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এক নতুন রাজনৈতিক উদ্দীপনা ও আশার সঞ্চার করেছে। ভাষণটি দেওয়ার পর থেকেই এটি দেশজুড়ে আলোচনার প্রধান বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যাকে বলা যায় টক অব দ্য কান্ট্রি।
নির্বাসন থেকে ১৭ বছর পর গত বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) তারেক রহমান মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। তার জন্য রাজধানী ঢাকার পূর্বাচলের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়েতে (৩০০ ফিট) আয়োজিত গণসংবর্ধণার জবাবে তিনি ভাষণটি দেন। অভূতপূর্ব জনজোয়ারকে সম্বোধন করেন, ‘প্রিয় বাংলাদেশ’।
এই ভাষণে তারেক রহমান দেশ ও জনগণের জন্য তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে বলে ঘোষণা দেন। তিনি ভাষণে বলেন, ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান ফর দ্য পিপল, ফর দ্য কান্ট্রি’। তার পরিকল্পনাটি জনকল্যাণ ও দেশের ভাগ্য পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটি ভিশনারি চিন্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তারেক রহমান ‘আই হ্যাভ আ প্ল্যান’ বক্তৃতাটি দিতে গিয়ে আমেরিকার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ বা ‘আমার একটি স্বপ্ন আছে’ ভাষণটি স্মরণ করেন। প্রায় ৬২ বছর আগে ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট মার্টিন লুথার কিং তার বিখ্যাত ভাষণটি দিয়েছিলেন। ওয়াশিংটনের লিংকন মেমোরিয়ালের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে। সেখানে উপস্থিত আড়াই লাখ আমেরিকান জনগণের ওপর এই ভাষণের প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূরপ্রসারী। আমেরিকান ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম এই নাগরিক অধিকার সমাবেশে মার্টিন লুথার কিং তার দেওয়া ভাষণে কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গÑ উভয়ের মধ্যেই সাম্য ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলেছিলেন। এই ভাষণটি বিশ্বমানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃত।
মার্টিন লুথার কিং যেমন একটি স্বপ্নের কথা আমেরিকান জনগণের সামনে তুলে ধরেছিলেন, তেমনি তারেক রহমানও ৩০০ ফিটের ৩৬ জুলাই এক্সপ্রেসওয়েতে লাখ লাখ মানুষের সামনে তার ভিশন তুলে ধরেন। মাত্র ১৬ মিনিটের ভাষণে মার্টিন লুথার কিংয়ের মতো তিনিও জনগণের মাঝে বিশাল স্বপ্ন ও আশা জাগিয়ে দেন। তারেক রহমান তার পরিকল্পনার কথা বলতে গিয়ে দেশের চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে শান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দেন। লুথার কিং যেমন বর্ণবাদমুক্ত সমাজের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তারেক রহমান তেমনি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি পাহাড়-সমতল, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানÑ সবার জন্য সমান সুযোগ ও নিরপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনের ডাক দেন।
মার্টিন লুথার কিংয়ের আন্দোলন যেমন ছিল নাগরিক অধিকারের জন্য, তারেক রহমানও তেমনি আমাদের জনগণের কথা বলার অধিকার এবং ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার ওপর জোর দেন। দেশ পুনর্গঠনে তরুণপ্রজন্মের ওপর আস্থা রাখা এবং তাদের সৃজনশীলতাকে কাজে লাগিয়ে একটি আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার মর্মবাণীই ছিল তারেক রহমানের ভাষণ। তিনি যেকোনো ধরনের উস্কানি ও বিশৃঙ্খলা পরিহার করে ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে দেশের শান্তি বজায় রাখার কথা বলেন।
তারেক রহমান সুশাসন ও ন্যায়বিচারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রদর্শিত ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে তার আলোকে দেশ পরিচালনা করা এবং জবাবদিহিমূলক সরকার ব্যবস্থা কায়েম করার প্রতিশ্রুতি দেন। তার ভাষণের মূল বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল দেশের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা, জাতীয় ঐক্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠন, গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা রোধ, তরুণপ্রজন্মের নেতৃত্ব, স্বাস্থ্যসেবায় নতুন নীতি, ধর্মীয় ও নৈতিক মূল্যবোধ, পরিবেশ ও অবকাঠামো এবং ক্রীড়া ও শিক্ষার কথা।
তারেক রহমানের ভাষণের পর সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষের একটি বড় অংশ ইতিবাচক মন্তব্য করে চলেছেন।
তারা এই ভাষণকে ‘জাতীয় ঐক্যের ডাক’ এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতির প্রশংসা করেন। অনেকেই মন্তব্য করেনÑ এই ভাষণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন গতির সঞ্চার করেছে এবং আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মানুষের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ এই ভাষণকে ‘অনুপ্রেরণামূল ও আশাব্যঞ্জক’ হিসেবে বর্ণনা করেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম তারেক রহমানের বক্তব্যকে ‘গণতান্ত্রিক উত্তরণ’ হিসেবে অভিহিত করেন। তার মতে, তারেক রহমানের আগমন রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তেমনি জুলাই আন্দোলনের ছাত্রনেতা হাসনাত আবদুল্লাহ মন্তব্য করেন, তারেক রহমানের ফিরে আসা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংগ্রামের একটি ‘মাইলফলক’।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আল মাসুদ হাসানুজ্জামান তারেক রহমানের বক্তব্যকে তৃণমূলের নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘আত্মবিশ্বাস, উদ্দীপনা ও আশা জাগানিয়া’ বলে মন্তব্য করেন। সামাজিক মাধ্যমে একজন মন্তব্য করেন, তারেক রহমানের ভাষণে প্রায় চার কোটি তরুণকে দেশ পুনর্গঠনে কারিগর হিসেবে বিবেচনা করা, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের স্বপ্ল সময়ে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা, পাঁচ বছরে ২৫ কোটি গাছ লাগানো, ২০ হাজার কিলোমিটার নদী ও খাল খনন, ফ্যামিলি কার্ড ও কৃষি কার্ড দেওয়ার পরিকল্পনা, ইমাম-মুয়াজ্জিন ও অন্যান্য ধর্মের গুরুদের বিশেষ ভাতা প্রদান, চতুর্থ শ্রেণি থেকে বাধ্যতামূলক ক্রীড়া শিক্ষা চালু করতে ৬৪ জেলায় ‘স্পোর্টস ভিলেজ’ নির্মাণ করা তারেক রহমানের ভিশনারি চিন্তারই ফসল।
