English

16 C
Dhaka
রবিবার, ডিসেম্বর ২৮, ২০২৫
- Advertisement -

রাজনীতির নতুন মেরুকরণ ও এনসিপি: টিকে থাকার লড়াই ও কৌশলগত বাস্তবতা

- Advertisements -

জাহিদ ইকবাল: ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার মহাবিপ্লব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ (এনসিপি)। জুলাই-আগস্টের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে ফ্যাসিবাদ পতনে এনসিপির ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে দলটির প্রয়োজনীয়তা যখন মধ্যগগনে, ঠিক তখনই জামায়াত নেতৃত্বাধীন ৮ দলীয় জোটে এনসিপির যোগদান নিয়ে রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। তবে যারা মনে করছেন এই সিদ্ধান্তের ফলে এনসিপি তার স্বকীয়তা হারাবে বা এক বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাবে, তারা রাজনীতির দীর্ঘমেয়াদী সমীকরণ বুঝতে ভুল করছেন।

জুলাই-আগস্টের স্পিরিট রক্ষা করা এবং নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গড়ার ক্ষেত্রে এনসিপির গুরুত্ব অপরিসীম। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান রাজনীতিতে কোনো দলই এককভাবে টিকে থাকা সহজ নয়। এনসিপি বামপন্থীদের সাথে গেলে এক পক্ষ সমালোচনা করবে, আবার বিএনপি বা জামায়াতের সাথে গেলেও সমালোচনা হবে—এটাই এ দেশের রাজনীতির রূঢ় বাস্তবতা। এনসিপি সেই পথটিই বেছে নিয়েছে যেখানে তারা তুলনামূলক শক্ত অবস্থান পাবে এবং জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে কার্যকর রাজনৈতিক স্পেস নিশ্চিত করতে পারবে।
যেকোনো নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের শুরুতে ভুল-ত্রুটি বা অসামঞ্জস্য থাকা স্বাভাবিক। সফটওয়্যার প্রযুক্তির মতো রাজনীতিতেও ধাপে ধাপে ‘আপডেট’ আসে। যারা এক বছরের মধ্যে এনসিপির সব ভুল দূর করে পরিপূর্ণ সংস্করণের প্রত্যাশা করেন, তারা সম্ভবত রাজনীতির অতীত ইতিহাস ও গতিশীলতা নিয়ে সচেতন নন।

সর্বপ্রথম যে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন তা হলো—‘রাজনৈতিক জোট’ আর ‘নির্বাচনী জোট’ এক জিনিস নয়। এনসিপি জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেওয়াকে আদর্শিক একীভূতকরণ না দেখে ‘নির্বাচনী ও কৌশলগত সমঝোতা’ হিসেবে দেখাই শ্রেয়। দীর্ঘমেয়াদী (৩০ বছরের) পরিকল্পনায় এনসিপিকে হয়তো ভবিষ্যতে বিএনপির সাথেও নির্বাচনী জোট করতে হতে পারে। অতীতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াত—সব দলই ক্ষমতার প্রয়োজনে একে অপরের সাথে নির্বাচনী জোট করেছে। এতে কোনো দলেরই অস্তিত্ব বিলীন হয়নি।

এনসিপির বর্তমান কৌশলের লক্ষ্য হওয়া উচিত ২০২৬ সালের নির্বাচনে অন্তত ৫-১০টি সংসদীয় আসন নিশ্চিত করা। মাঠের রাজনীতিতে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে হলে সংসদীয় উপস্থিতি অপরিহার্য। নির্বাচনী রাজনীতি যে কেবল ফেসবুক বা ইউটিউবভিত্তিক অ্যাক্টিভিজম নয়, তা বোঝার জন্য মাঠপর্যায়ের সংগঠন গড়া এবং প্রতিপক্ষের চাপ মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে।

জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেনের মতে, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নে অনেক সময় বড় দলগুলোর সাথে মতভিন্নতা তৈরি হয়। কিন্তু নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে মূল এজেন্ডা, সেখানে এনসিপি, জামায়াত এবং জোটভুক্ত অন্য দলগুলোর মধ্যে একটি স্বাভাবিক ঐকমত্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সংস্কারের অঙ্গীকার এবং দেশ গঠনের প্রতিশ্রুতিই বর্তমান জোটের প্রধানতম বিবেচ্য বিষয়।

রাজনীতি মানেই হলো ভিন্ন ভিন্ন মতের সহাবস্থান। একটি দলে বা জোটে যোগ দিলে শতভাগ নিজের মনের মতো সিদ্ধান্ত পাওয়া সম্ভব নয়। বৃহত্তর স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই রাজনৈতিক শিষ্টাচার। আজ যারা এই জোট নিয়ে হৈচৈ করছেন, তারা মূলত এনসিপিকে মাঠের লড়াই থেকে দূরে রেখে ড্রয়িংরুম রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ দেখতে চান।

রাজনীতির লং রানে বিজয়ী হওয়ার মূল শর্ত হলো টিকে থাকা। এনসিপি আজ জামায়াত নেতৃত্বাধীন জোটে গিয়ে যে রাজনৈতিক স্পেসটি তৈরি করেছে, তা তাদের মাঠের সংগঠন শক্তিশালী করতে সাহায্য করবে। মনে রাখা দরকার, ৩০ বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট হয়েছিল, তাতে বিএনপির রাজনৈতিক মৃত্যু ঘটেনি। ঠিক তেমনি, এনসিপির এই পদক্ষেপ তাদের সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার একটি কৌশল মাত্র।

উপসংহারে বলা যায়, এনসিপি কেবল একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি জুলাই বিপ্লবের পাহারাদার। নতুন বাংলাদেশে তাদের গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রাখতে হলে কৌশলী হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। রাজনীতির প্রকৃত নেতা তৈরি হয় বাস্তব লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নয়। এনসিপি যদি মাঠের বাস্তবতা ও জনগণের সংস্কারের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সঠিক সমন্বয় ঘটিয়ে টিকে থাকতে পারে, তবেই তারা আগামীর বাংলাদেশে একটি অপরাজেয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।

লেখক পরিচিতি: সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।

The short URL of the present article is: https://www.nirapadnews.com/6407
Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন