এস এম আজাদ হোসেন: বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন মুখস্থবিদ্যার কারাগারে বন্দি। এখানে শিক্ষার মান নির্ধারিত হয় কে কত নম্বর পেল, কে কত বেশি বই মুখস্থ করল, অথবা কে সবচেয়ে ভালো কোচিং করল-এইসব তথাকথিত সফলতার মাপকাঠিতে। অথচ এই চমকপ্রদ ফলাফলও সমাজকে মানবিক, সৎ ও নৈতিক নাগরিক দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। বরং এই নম্বরনির্ভর ব্যবস্থাই আজ সমাজে জন্ম দিচ্ছে একেকটি ‘সার্টিফিকেটধারী আত্মকেন্দ্রিক’ প্রজন্ম, যাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের চিহ্নও খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এক সময় স্কুল-কলেজ ছিল নৈতিক শিক্ষা ও দেশপ্রেমের প্রথম পাঠশালা। শিক্ষক ছিলেন সমাজগঠনের কারিগর। কিন্তু আজ শিক্ষকদের অনেকেই কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, শিক্ষার্থীর কাছে শ্রদ্ধার প্রতীক হওয়ার বদলে হয়ে উঠছেন টাকার বিনিময়ে উত্তর দেওয়ার ‘উৎপাদক’। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছে পরীক্ষার প্রস্তুতির কারখানা-জীবন গঠনের নয়।
একজন শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পা রাখার পর থেকেই ‘প্রথম হও’, ‘নম্বর বাড়াও’-এই দৌড়ের মাঝে পড়ে নিজের চিন্তাশক্তি, কল্পনা ও নৈতিক বিবেচনার জায়গাগুলো হারিয়ে ফেলে। পাঠ্যপুস্তকে মানবিক গল্প থাকলেও,পরীক্ষায় আসে নির্দিষ্ট প্রশ্নের নির্দিষ্ট উত্তর। এতে করে শিক্ষার্থীরা শিখছে না কীভাবে ভালো মানুষ হতে হয়, বরং শিখছে কীভাবে প্রশ্নফাঁসের সুবিধা নিতে হয়।
প্রশ্নফাঁস, ভুয়া মেধা, ভর্তি জালিয়াতি-এসব এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি সাংগঠনিক ব্যাধি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও মেধার বদলে টাকা-পয়সা বা প্রভাবশালী পরিচয় বড় হয়ে উঠছে। এতে করে প্রকৃত মেধাবীরা হারিয়ে যাচ্ছে, আর উঠে আসছে সুবিধাবাদীরা। এদের কেউ কেউ একসময় দায়িত্বশীল পেশায় গিয়ে দুর্নীতির সংস্কৃতি চালু করছে। এভাবেই শিক্ষা থেকে শুরু হয়ে সামাজিক অবক্ষয়ের বীজ ছড়ানো শুরু হয়।
শিক্ষাব্যবস্থার আরও একটি সংকট হল ‘মানবিক শূন্যতা’। বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা ও প্রযুক্তির চাপে সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসচর্চা আজ বিলুপ্তির পথে। একজন উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থী শেক্সপিয়র বা রবীন্দ্রনাথের নাম জানে না, জানে না মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ-এমন ঘটনাও অহরহ। ফলে তার দৃষ্টিভঙ্গি সীমাবদ্ধ, সে সমাজ ও ইতিহাসকে মূল্যায়নের চোখে দেখে না।
এছাড়া, শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি ভুল প্রমাণিত হচ্ছে যখন দেখা যাচ্ছে, হাজার হাজার স্নাতক চাকরির বাজারে বসে আছে, কিন্তু দক্ষতা ও সৃজনশীলতার অভাবে তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। তাদের মধ্যে হতাশা জন্ম নিচ্ছে, জন্ম নিচ্ছে ক্ষোভ ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। অনেকেই চলে যাচ্ছে নেশা, অপরাধ বা উগ্র রাজনীতির পথে।
শিক্ষাকে যদি কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাহন হিসেবে দেখা হয়, তাহলে তা মানবিক উন্নয়নের জায়গা হারায়। উন্নত দেশগুলো শিক্ষা ব্যবস্থাকে মানবিকতা, যুক্তিবোধ ও নাগরিক দায়িত্ববোধের প্রশিক্ষণ হিসেবেই বিবেচনা করে। অথচ আমরা এখানেই পিছিয়ে আছি।
কিছু উদাহরণ আশা জাগায় বটে। কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক আছেন, যারা শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তা ও সমাজবোধে উদ্বুদ্ধ করেন। কিন্তু তাদের সংখ্যা হাতেগোনা। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন উদ্যোগ-যেমন সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি বা কারিকুলামের পরিবর্তন-ভালো উদ্যোগ হলেও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে।
সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের প্রথমে স্বীকার করতে হবে-শিক্ষার সংকট শুধু কারিগরি নয়, এটি আদর্শিক ও নৈতিক সংকট। পাঠ্যক্রমে মানবিকতা, নৈতিকতা, পরিবেশ সচেতনতা, ইতিহাসচেতনা ও সমাজবিজ্ঞানকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষকদের পুনঃপ্রশিক্ষণ ও তাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তারা কোচিং নির্ভর না হন।
একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিক্ষার উপর। আর সে শিক্ষা যদি মানবিক না হয়, যদি তা সমাজের দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি না করে-তাহলে উন্নয়ন হবে কেবল অবকাঠামোর, মানুষ থাকবে অন্ধকারে। এই অন্ধকার থেকে বের হওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শেকড়েই পরিবর্তন আনতে হবে। শেষ নয়-শুরু।।
লেখকঃ কলাম লেখক,সমাজকর্মী।