এস এম আজাদ হোসেন: ২৬ জুন—জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচারবিরোধী দিবস। প্রতিবারের মতো এবারও দিবসটির প্রতিপাদ্য জোর দেয় সচেতনতা, প্রতিরোধ এবং সহযোগিতার ওপর। ২০২৫ সালের প্রতিপাদ্য হলো:
“Evidence is Clear: Invest in Prevention” — অর্থাৎ “প্রমাণই বলে: প্রতিরোধে বিনিয়োগ করুন”।
এই প্রতিপাদ্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, শুধু আইন দিয়ে নয়—নেশার ভয়াবহ আগ্রাসন ঠেকাতে হলে প্রয়োজন প্রতিরোধমূলক সামাজিক বিনিয়োগ। বাংলাদেশে এই বার্তাটি কতটা কার্যকরভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে? কতটা সফল আমরা, মাদকের ভয়াল ছোবল থেকে তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে?
একটি অদৃশ্য মহামারী: বাংলাদেশে মাদকের ভয়াবহতা
বাংলাদেশে মাদক সমস্যাকে অনেকটা “স্রোতের নিচের ঢেউ” হিসেবে দেখানো হয়। এটি যতটা না দৃশ্যমান, তার চেয়ে বেশি নীরব, ছদ্মবেশী এবং ধ্বংসাত্মক।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণার তথ্য অনুযায়ী:
বাংলাদেশে প্রায় ৮০-৯০ লাখ মানুষ কোনো না কোনোভাবে মাদকের সঙ্গে জড়িত (সূত্র: মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও ব্র্যাকের যৌথ জরিপ, ২০২৪)।
৮৫ শতাংশ মাদকসেবীই ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী তরুণ।
মাদকসেবনের গড় বয়স প্রতি বছর কমছে; এখন তা অনেকক্ষেত্রে ১৩ বছরেও নেমে এসেছে।
মাদক সংক্রান্ত মামলার হার ২০১৯-২০২৪ সময়কালে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
সবচেয়ে বেশি প্রচলিত মাদক: ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন এবং আইস (ক্রিস্টাল মেথ)।
ইয়াবা আগ্রাসন: সীমান্ত ছেদিয়ে ভয়াবহ ঢল
বাংলাদেশে ইয়াবার প্রবেশ ঘটে মূলত মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে। কক্সবাজার, বান্দরবান ও টেকনাফ হয়ে প্রতিদিন লক্ষাধিক ইয়াবা ট্যাবলেট পাচার হয় বলে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দাবি।
২০১৮ সালে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির আওতায় মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হলে সাময়িকভাবে প্রবাহ কমে, তবে ২০২৩-২৪ সালে আবারও প্রবলভাবে ফিরে আসে ইয়াবা স্রোত।
বর্তমানে নতুন ধরনের মাদক যেমন আইস (Methamphetamine Crystals) তরুণদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এটি অধিক ঘনত্বের, উচ্চমাত্রায় আসক্তিকর এবং স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক।
মাদক পাচার ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা: একটি অব্যক্ত আতঙ্ক
মাদকের বিস্তার শুধু সীমান্ত বা গলিপথের সমস্যায় সীমাবদ্ধ নয়—এর পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী চক্র, যার সঙ্গে রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও প্রশাসনিক দুর্বলতা জড়িত।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ, প্রভাবশালী নেতা বা জনপ্রতিনিধিরা অনেকক্ষেত্রে অভিযুক্ত হলেও শাস্তি পান না।
২০২৩ সালে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৮টি জেলার স্থানীয় নেতৃবৃন্দ মাদকের ব্যবসার পৃষ্ঠপোষকতায় জড়িত।
তদ্বির, প্রভাব খাটানো এবং ‘ক্রসফায়ার’ সংস্কৃতির আশ্রয়ে এই চক্র কার্যত ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
মাদকবিরোধী অভিযান: আইন বলবৎ নাকি লোক দেখানো প্রতীকী যুদ্ধ?
২০১৮ সালে সরকার মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে। কয়েক হাজার গ্রেপ্তার, শতাধিক বন্দুকযুদ্ধে নিহত, প্রচুর ইয়াবা উদ্ধার হয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে:
এই অভিযান কি দীর্ঘমেয়াদে ফল দিয়েছে?
আসক্তি কমেছে, না কেবল ব্যবসার রুট পাল্টেছে?
বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ কি আইন শাসনের প্রতি আস্থা নষ্ট করেনি?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, কেবল অভিযান নয়, প্রয়োজন সামাজিক কাঠামোগত প্রতিরোধ। এক্ষেত্রে স্কুল, পরিবার, মিডিয়া ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনিবার্য।
মাদক ও তরুণ সমাজ: হারিয়ে যাচ্ছে সম্ভাবনার পৃথিবী
মাদক সবচেয়ে ভয়াবহভাবে আঘাত করেছে তরুণ সমাজে।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে স্কুলের কিশোর, কলেজপড়ুয়া বা কর্মহীন যুবক—সবাই আজ নেশার ভয়াল চক্রে জড়িয়ে পড়ছে।
এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার প্রায় ৩৭ শতাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত।
হোস্টেল, পার্টি, নাইট ক্লাব বা বন্ধুবান্ধবের মাধ্যমে প্রথমবার মাদক গ্রহণ করেন প্রায় ৭৪ শতাংশ।
পরিবারের বিচ্ছিন্নতা, মানসিক চাপ, একাকিত্ব, বেকারত্ব এবং সামাজিক অবক্ষয়—এসবই তরুণদের নেশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রতিরোধ কোথায়? প্রয়োজন বৈপ্লবিক সামাজিক পুনর্গঠন
বর্তমান পরিস্থিতি দেখে বোঝা যায়—শুধু আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রয়োজন:
১. সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা
পরিবারে সন্তানদের সঙ্গে খোলামেলা সম্পর্ক গড়ে তোলা,
স্কুলে মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদকবিরোধী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা,
সামাজিক সংগঠন ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কার্যকর ভূমিকা নিশ্চিত করা।
২. ডিজিটাল মাধ্যম ও সেলিব্রিটি ক্যাম্পেইন
সোশ্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় কনটেন্ট নির্মাতাদের দিয়ে মাদকবিরোধী বার্তা ছড়ানো,
টিভি নাটক, সিনেমা ও মিউজিক ভিডিওতে মাদকের অপব্যবহারকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরা।
৩. পুনর্বাসন কেন্দ্র ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে গুণগত পুনর্বাসন কেন্দ্র বাড়ানো,
নেশা থেকে ফিরে আসতে চাওয়া যুবকদের জন্য আত্ম-উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি।
৪. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে মাদক পাচারবিরোধী যৌথ উদ্যোগ জোরদার,
সাইবার মাদক বাণিজ্য (Dark Web) ঠেকাতে আইটি সেল গঠন।
সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের দায়
গণমাধ্যমের কাজ কেবল সংবাদ পরিবেশন নয়, বরং সমাজকে সচেতন করা ও জনমত গড়ে তোলা।
মাদক-সম্পর্কিত অনুসন্ধানী রিপোর্ট, জীবনের গল্প, সফল পুনর্বাসনের উদাহরণ—এসবই তরুণদের আশা দেখাতে পারে।
একইভাবে, নাগরিক সমাজের প্রতিটি স্তরে “মাদক নয়, জীবন বেছে নিন” এই বার্তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে।
উপসংহার:
মাদক সমস্যা নিছক আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়—এটি জাতির ভবিষ্যৎকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া নীরব দুর্যোগ।
যেখানে প্রতিদিন নতুন তরুণ নেশায় ঝুঁকছে, পরিবার ভেঙে পড়ছে, কর্মক্ষমতা কমছে—সেখানে প্রতিরোধ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।
আসুন, প্রতিশ্রুতি হোক— “নেশা নয়, নতুন জীবন গড়ি। শাস্তি নয়, সচেতনতা ও সহানুভূতির মাধ্যমে সমাজকে ফিরিয়ে আনি। মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি—এই হোক ২৬ জুনের অঙ্গীকার।”
লেখকঃ সাংবাদিক,সোস্যাল এক্টিভিস্ট।