প্রযুক্তির বিবর্তনে বদলে যাচ্ছে আকাশপথের নিরাপত্তাব্যবস্থাও। বিমান দুর্ঘটনার তদন্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পরিচিত ব্ল্যাক বক্স এখন আর শুধু তথ্য সংগ্রাহক নয়, হয়ে উঠছে স্মার্ট বিশ্লেষক। এটির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ক্লাউড স্টোরেজ এবং রিয়েল-টাইম মনিটরিং প্রযুক্তি। ফলে ভবিষ্যতের ফ্লাইট নিরাপত্তা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আরও নির্ভরযোগ্য ও আগাম সতর্কতামূলক হয়ে উঠছে।
ব্ল্যাক বক্স কী : নাম ব্ল্যাক বক্স হলেও এটি কালো কোনো বাক্স নয়। এটি মূলত কমলা রঙের একটি ডিভাইস। ব্ল্যাক বক্স বলতে সাধারণত বোঝানো হয় দুটি আলাদা রেকর্ডিং ইউনিট।
ককপিট ভয়েস রেকর্ডার : ককপিটে চালকের কথোপকথন, এলার্ম সাউন্ড, যন্ত্রপাতির শব্দ রেকর্ড করে।
ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার : বিমানের গতি, উচ্চতা, অবস্থান, থ্রাস্ট, ব্রেকিং সিস্টেম, ফ্ল্যাপ অবস্থা, ইঞ্জিন পারফরম্যান্সসহ হাজারো ডেটা সংরক্ষণ করে।
প্রতিটি আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী বিমানে ব্ল্যাক বক্স থাকা বাধ্যতামূলক। এগুলো বিমানের লেজ অংশে স্থাপন করা হয়, যেখানে দুর্ঘটনার ধকল তুলনামূলক কম পড়ে।
চরম অবস্থায়ও টিকে থাকে যেভাবে : ব্ল্যাক বক্সের অন্যতম বিশেষত্ব হচ্ছে এর সহনশীলতা। এটি ১,১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করতে পারে। সাগরের ২০,০০০ ফুট গভীরেও এটি ৩০ দিন পর্যন্ত সিগন্যাল পাঠাতে পারে। বাইরের শক বা ধ্বংসাত্মক আঘাত থেকে রক্ষা পেতে ডিভাইসটি থাকে একাধিক স্তরে আবৃত। অন্তর্ভুক্ত থাকে একটি ‘আন্ডার ওয়াটার লোকেটর বেকন, যা পানির নিচে প্রতি সেকেন্ডে একবার করে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ পাঠায়- যার সাহায্যে উদ্ধারকারী দল ব্ল্যাক বক্স খুঁজে বের করতে পারে।
বিশ্লেষণে নতুন বিপ্লব : আধুনিক বিমান সংস্থাগুলো এখন ব্ল্যাক বক্সের পাশাপাশি এআই-ভিত্তিক বিশ্লেষণ সিস্টেম যুক্ত করছে। যাতে শুধু দুর্ঘটনার পরে নয়, ফ্লাইট চলাকালীন অবস্থায়ও ঝুঁকি চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে।
AI কীভাবে যুক্ত হচ্ছে : স্বয়ংক্রিয়ভাবে অস্বাভাবিক ডেটা শনাক্ত করে সতর্কতা পাঠাতে পারে। আগের শত শত ফ্লাইট ডেটা বিশ্লেষণ করে সম্ভাব্য সমস্যা অনুমান করতে পারে।
দুর্ঘটনার পরে তদন্তে মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত ও নির্ভুল তথ্য উপস্থাপন করতে পারে। বিশ্বের নামকরা এয়ারক্রাফট নির্মাতা বোয়িং, এয়ারবাস এবং কিছু এভিয়েশন সেফটি এজেন্সি এই প্রযুক্তি ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার শুরু করেছে।
ক্লাউড ও রিয়েল-টাইম ট্র্যাকিং : আগে ব্ল্যাক বক্সের তথ্য পেতে বিমানটি খুঁজে পাওয়া, উদ্ধার করা এবং ডেটা রিড করতে হতো। এখন ক্লাউড-সংযুক্ত ব্ল্যাক বক্স প্রযুক্তির মাধ্যমে ফ্লাইট চলাকালীনই সব ডেটা কেন্দ্রীয় সার্ভারে আপলোড হচ্ছে। ফলে দুর্ঘটনার আগেই আচরণগত অস্বাভাবিকতা শনাক্ত করা যাচ্ছে। দুর্ঘটনার পর ডেটা পুনরুদ্ধারের জন্য ফিজিক্যাল ব্ল্যাক বক্সের ওপর নির্ভরতা কমছে। তদন্তে সময়, খরচ এবং জটিলতা কমে আসছে।
ভবিষ্যৎ ব্ল্যাক বক্স যেমন হতে পারে : বিশেষজ্ঞদের মতে, ভবিষ্যতে প্রতিটি যাত্রী হয়তো নিজ নিজ স্মার্ট ডিভাইস, যেমন- স্মার্টওয়াচ, স্মার্টফোন বা হেলথ ট্র্যাকার-এর মাধ্যমে ব্যক্তিগত পর্যায়ের ব্ল্যাক বক্সের মতো ডেটা রেকর্ড করতে পারবে। এর ফলে যাত্রীর আচরণগত তথ্য, চাপ, হার্টবিট বা ফিজিওলজিক্যাল ডেটাও সিস্টেমে যুক্ত হতে পারে। এতে ফ্লাইট নিরাপত্তা এবং পরবর্তী বিশ্লেষণে আরও গভীর স্তরের তথ্য পাওয়া যাবে।
ব্ল্যাক বক্স এখন আর কেবল দুর্ঘটনার পরে উদ্ধার করা কোনো যন্ত্র নয়- এটি হয়ে উঠেছে ফ্লাইট নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান প্রযুক্তি সহায়ক। AI ও ক্লাউডভিত্তিক প্রযুক্তির সংযোজনের মাধ্যমে এটির কার্যকারিতা এবং প্রভাব বহুগুণ বেড়েছে।
আগামী দিনে আকাশপথে যাত্রা শুধু গতিময় নয়, আরও সচেতন, বুদ্ধিমান ও ভবিষ্যৎমুখী হয়ে উঠবে এই প্রযুক্তিগুলোর যৌথ প্রয়োগের ফলেই।