English

26 C
Dhaka
শুক্রবার, জুন ৬, ২০২৫
- Advertisement -

উৎসবের যাত্রা যেন পরিণত না হয় শোকযাত্রায়

- Advertisements -

এস এম আজাদ হোসেন: আনন্দ, উদ্দীপনা, মিলন আর উৎসব-ঈদ মানেই এমন এক আবেগ, যা সব বয়সের মানুষের হৃদয়ে এক রকম আলোড়ন তোলে। এই অনুভূতির শিকড়টা পরিবার আর আপনজনের সঙ্গে সময় কাটানোর আকাঙ্ক্ষায় দৃঢ় হয়ে ওঠে। তাই ঈদ এলেই মানুষ ছুটে চলে প্রিয়জনের কাছে-বাস, ট্রেন, লঞ্চ, এমনকি কোনোভাবে যদি সম্ভব হয়,হেঁটেও। বিশেষ করে কোরবানির ঈদে এই যাত্রার ধরণ হয়ে পড়ে আরও জটিল। পশুবাহী ট্রাক, বাসে অতিরিক্ত যাত্রী,নৌযানে অতিরিক্ত বোঝাই-সব মিলিয়ে দেশের পরিবহন খাত হয়ে ওঠে এক অনিয়ন্ত্রিত,ঝুঁকিপূর্ণ দুর্ভাগ্যগাঁথা।

আমরা সবাই জানি, প্রতিটি ঈদে বিশেষ করে কোরবানির ঈদের আগে-পরে দেশের সড়ক, রেল ও নৌপথে ঘটে অসংখ্য প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। কিছুটা অব্যবস্থাপনা, কিছুটা অবহেলা, আবার অনেকটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে এই দুর্ঘটনাগুলো যেন ঈদের স্থায়ী উপসর্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ সামান্য কিছু সচেতনতা, প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন ও নাগরিক দায়িত্ববোধ থাকলেই আমরা অনেক বড় ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে পারি।

ঈদের সময়টাতে আমাদের দেশের পরিবহন ব্যবস্থার একটি চিত্র খুব পরিচিত হয়ে উঠেছে-বাসের ছাদে অতিরিক্ত যাত্রী, ট্রেনের ছাদে-দরজায় ঝুলে থাকা যাত্রী, কিংবা লঞ্চের ছাদে গাদাগাদি করে চলা মানুষ। এদের কারো চোখে আনন্দ, আবার কারো চোখে উদ্বেগ। কারণ সবাই জানে, এমন যাত্রায় অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যেতে পারে যেকোনো সময়।

সড়কপথে বাসগুলোর অধিকাংশই নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত যাত্রী নেয়। অতিরিক্ত যাত্রী তো বটেই, বহু চালক ঈদের সময় দিনে ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা একটানা ড্রাইভ করে যান-ঘুমহীন, বিশ্রামহীন। এর ফলে বেড়ে যায় সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি। বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, ঈদুল আজহার আগে-পরে ২০২৩ সালে সড়কে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছিল প্রায় ৩৯৮ জন, আহত আরও কয়েকশত। আর এই তালিকায় শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যা ছিল চোখে পড়ার মতো।
ঈদের সময় রেলপথ দেশের বড় একটি জনগোষ্ঠীর ভরসা। স্বল্পমূল্য, তুলনামূলক নিরাপদ এবং তুলনামূলকভাবে সময়ানুযায়ী হওয়ায় ট্রেনের প্রতি মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু এখানেও সমস্যা রয়েছে। ট্রেনের ছাদে উঠে যাত্রা, অনিয়ন্ত্রিত টিকিট বাজার, সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য-সব মিলিয়ে মানুষ যেন টিকিট না পেয়ে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেই রওনা হয়। একটি চলন্ত ট্রেনের ছাদে বসে দীর্ঘ ৮-১০ ঘণ্টা ভ্রমণ করা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এ রকম ঝুঁকিপূর্ণ ভ্রমণে প্রতিবছর ঘটে প্রাণহানি, কিন্তু তার কোন স্থায়ী সমাধান আজও নেই।

বাংলাদেশের নদীমাতৃক ভূগোল নৌপথকে করে তুলেছে গুরুত্বপূর্ণ এক পরিবহন মাধ্যম। কিন্তু ঈদের সময় অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে লঞ্চগুলো চলে ভয়ংকরভাবে। অতীতের ইতিহাসে বহু বড় বড় নৌ-দুর্ঘটনার চিত্র রয়েছে, যার একটি বড় অংশ ঈদকে ঘিরে যাত্রীচাপের সময় ঘটেছে। ২০০৩ সালের পিনাক-৬ দুর্ঘটনা, কিংবা ২০১৪ সালের মেঘনা নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় লঞ্চডুবি-সবই আমাদের সতর্ক হতে শিখিয়েছে, কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর বাস্তব ভূমিকা প্রায়শই প্রশ্নবিদ্ধ থাকে।

ঈদ এলে সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা নানা রকম উদ্যোগের কথা বলে। বিআরটিএ, পুলিশ, রেল কর্তৃপক্ষ, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সবাই ঘোষণা দেয়, বিশেষ অভিযান চলছে, অতিরিক্ত ভাড়া বন্ধ, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই নিষিদ্ধ ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতার চিত্র ভিন্ন। সড়কে বাড়তি ভাড়া আদায়, লাইসেন্সবিহীন চালকের দাপট,ফিটনেসবিহীন গাড়ি, রেলের টিকিট কালোবাজারি, লঞ্চে অতিরিক্ত বোঝাই-এসবই বিদ্যমান থাকে।

প্রশ্ন হলো, তাহলে দায়টা কার? দায় শুধু রাষ্ট্রের? না কি আমাদেরও আছে নাগরিক হিসেবে দায়িত্ব?
আমরা অনেক সময় নিজেদের সচেতন বললেও ঈদযাত্রায় আমাদের আচরণ দেখলে বোঝা যায়, বিপদকে আমরাই আমন্ত্রণ জানাই। অতিরিক্ত ভাড়া দিয়েও গাদাগাদি করে উঠি বাসে, ট্রেনের ছাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চড়ে বসি, কিংবা ছুটির লোভে নির্ধারিত সময়ের আগেই কর্মস্থল ত্যাগ করে যাত্রা শুরু করি। আমাদের এই আচরণকেই পরিবহন সিন্ডিকেট কাজে লাগায়।

আমাদের আরও সচেতন হতে হবে। জানতে হবে-কোন বাস বা লঞ্চ অতিরিক্ত যাত্রী নেয়, কোথায় ভাড়া বেশি আদায় হয়, কোন চালকের বিরুদ্ধে আগের রেকর্ড আছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কেউ যদি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে, তাহলে অভিযোগ জানানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না কোথায় অভিযোগ করতে হয়, কিংবা মনে করে অভিযোগ করেও লাভ নেই। এই মনোভাব আমাদের দুর্বল করে দেয়।অভিযোগ করবেন যেভাবে:

বিআরটিএ হেল্পলাইন: ১৬৩৩৪,ভোক্তা অধিকার: ১৬১২১, রেল অভিযোগ কেন্দ্র: ১৩৯, নৌপরিবহন হেল্পডেস্ক: ০১৭৩৩-৩৩৩৯৯৯

কী করা দরকার?
১) বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন: সরকারকে শুধু ঘোষণায় সীমাবদ্ধ না থেকে মাঠ পর্যায়ে কার্যকর তদারকি নিশ্চিত করতে হবে। র‍্যাব, পুলিশ, বিআরটিএ-সব সংস্থার সমন্বয়ে একটি ‘ঈদ ট্রান্সপোর্ট টাস্কফোর্স’ গঠন করে আগেভাগে নজরদারি শুরু করতে হবে।

২) রেলের ও বাসের টিকিট কালোবাজার বন্ধ: ডিজিটাল সিস্টেমকে আরও শক্তিশালী করে টিকিট বিক্রিতে স্বচ্ছতা আনতে হবে। যাত্রী শনাক্তকরণ পদ্ধতি ও একাধিক যাত্রার টিকিট কেনা বন্ধ করতে হবে।

৩) নৌযান পরীক্ষা ও রুটিন পর্যবেক্ষণ: ঈদের সময় যেন অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই না হয়, সে জন্য আগে থেকেই ফিটনেস চেক, নিরাপত্তা সরঞ্জাম যাচাই, জেটিতে পর্যাপ্ত লঞ্চ রাখা এবং নদীপথে পুলিশি নজরদারি জরুরি।

৪) মিডিয়া ও নাগরিক সংগঠনের ভূমিকা: গণমাধ্যম ও সিভিল সোসাইটিকে আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে জনসচেতনতা গড়তে। স্কুল-কলেজে এই নিয়ে বিশেষ ক্যাম্পেইন হতে পারে, যা ভবিষ্যৎ নাগরিকদের প্রস্তুত করবে।

৫) দুর্ঘটনার পর সাড়া নয়, প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ: বাংলাদেশে আমরা সাধারণত দুর্ঘটনার পর সক্রিয় হই, প্রতিরোধমূলক চিন্তায় পিছিয়ে থাকি। এই সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা দরকার।

ঈদ যাত্রা যেন আনন্দের যাত্রাই থাকে, শোকের নয়-এটা নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। রাষ্ট্র, প্রশাসন, পরিবহন মালিক, চালক, যাত্রী-সবাই যদি নিজ নিজ জায়গা থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে, তাহলে দুর্ঘটনার হার অনেক কমানো সম্ভব।
আমরা চাই, ২০২৫ সালের ঈদযাত্রা হোক দুর্ঘটনামুক্ত, নিরাপদ এবং আনন্দময়। পরিবারকে নিয়ে হাসিমুখে বাড়ি ফেরা আর কর্মস্থলে ফিরে আসার পথ যেন শুধুই স্মৃতিমধুর হয়, দুর্বিষহ নয়। চলুন, এবার ঈদে আমরা প্রতিজ্ঞা করি-নিরাপত্তা ও সচেতনতাকেই সবচেয়ে বড় প্রস্তুতি হিসেবে বিবেচনা করব।

ঈদ মোবারক।
লেখকঃ কলামিস্ট,সোস্যাল এক্টিভিস্ট,মহাসচিব-নিরাপদ সড়ক চাই।-

Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন