এস এম আজাদ হোসেন: ৩১ মে। বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস। এই দিনটি এলেই আলোচনা হয় তামাকের ভয়াবহতা নিয়ে, উঠে আসে পরিসংখ্যান, শোনা যায় সরকারি উদ্যোগের বিবরণ, আর প্রতিজ্ঞা করা হয়-আগামী প্রজন্মকে তামাকমুক্ত রাখার। কিন্তু বাস্তবতার আয়নায় আমরা বারবার দেখি, তামাক এখন শুধু ব্যক্তিগত অভ্যাস নয়, এটি এক মারাত্মক সামাজিক বিষফলক। যা আমাদের শরীর, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, এমনকি সমাজের নৈতিক কাঠামোকেও ভেঙে দিচ্ছে নিঃশব্দে।
আজকের এই লেখায় আমরা শুধু তামাকের বিপদের কথা বলব না-বলব সেই বিপদ কীভাবে আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছে, স্বাস্থ্য খাতকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছে এবং ভবিষ্যতের জাতিকে গ্রাস করছে নিঃশব্দে।
তামাক: এক চতুর, নির্লজ্জ ব্যবসায়িক ষড়যন্ত্র
আজকের দুনিয়ায় তামাক একটি বৈধ পণ্য, অথচ তার ফলাফল প্রায় অবৈধ। গবেষণা বলছে, তামাকের জন্য বছরে বাংলাদেশে মারা যায় প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ-অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ৪৪০ জন। অথচ তামাক কোম্পানিগুলোর ব্র্যান্ডিং এখনও চলছে “স্টাইল”, “মুক্তি”, “উদ্দীপনা” আর “প্রাপ্তবয়স্কতার প্রতীক” হিসেবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, তামাক এমন একটি পণ্য যার সঠিক ব্যবহারও মৃত্যুবরণ নিশ্চিত করে। তারপরও এই পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছেও, যেখানে খাদ্য, শিক্ষা বা চিকিৎসার নিশ্চয়তা নেই, কিন্তু একটি বিড়ির জন্য পাঁচ টাকা চলে যাচ্ছে একজন দিনমজুরের পকেট থেকে।
তামাক কোম্পানিগুলোর কৌশল আজ আর গোপন নেই। তারা এখন কিশোরদের টার্গেট করছে। বাজারে এসেছে ফ্লেভার্ড ই-সিগারেট, রঙিন মোড়কে চকলেটের মতো গন্ধমাখা নিকোটিন পণ্য। এমনকি শহরের স্কুলের গেটের পাশেই এইসব পণ্য পাওয়া যায়-যা সরাসরি আইন লঙ্ঘন। কিন্তু প্রতিরোধ নেই। কেন?
স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অদৃশ্য ব্যয়: একটি অঙ্কের ভাষ্য
বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগের চিকিৎসায় বছরে খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এই টাকার অর্ধেকও যদি স্বাস্থ্যখাতের অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় হতো, তাহলে হয়তো প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে থাকতো আধুনিক আইসিইউ ইউনিট। অথচ বাস্তবতা হলো, এই টাকা ব্যয় হচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ফুসফুস ক্যানসার, কিডনি জটিলতা এবং প্যানক্রিয়াসের ক্ষয়জনিত চিকিৎসায়।
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, তামাকজনিত ধোঁয়া কেবল ফুসফুস নয়, কিডনির রক্তনালীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। ধীরে ধীরে রক্তচাপ বেড়ে কিডনি অকেজো হয়ে যায়। রোগীরা বুঝতেই পারেন না-তাদের ধূমপানের অভ্যাস কিভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে শরীরের মৌলিক অঙ্গটিকে।
ধূমপান ছেড়ে দিলে কিডনি কোষ ধীরে ধীরে পুনরায় কার্যক্ষম হতে পারে-এমন তথ্য থাকলেও সচেতনতা নেই। এবং আশঙ্কার বিষয় হলো, তরুণদের মধ্যে এখন ধূমপান শুরু হচ্ছে আরও আগেই-১২-১৪ বছর বয়স থেকেই।
আইন আছে, প্রয়োগ কোথায়?
বাংলাদেশে ২০০৫ সালে প্রথম তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়। পরে তা ২০১৩ সালে সংশোধন করা হয়। বর্তমান সরকার আবারো আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে, যেখানে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাক পণ্যের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ, এবং কর কাঠামো আরও কঠোর করার প্রস্তাব রয়েছে।
কিন্তু আইন কতটা কার্যকর?
আমরা দেখি, তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন এখনও গোপনে চলছে, কর ফাঁকি দেওয়া হচ্ছে, এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দুর্বলতা স্পষ্ট। জেলা প্রশাসন বা পৌর কর্তৃপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই নীরব দর্শক। রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং কর্পোরেট চাপ এই আইন বাস্তবায়নে বড় বাধা।
তামাক: নৈতিকতার সঙ্কটে সমাজ
ধূমপান শুধু স্বাস্থ্য সমস্যাই নয়, এটি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে শিশুরা বিজ্ঞাপন দেখে “কুল” হতে চায়, অন্যদিকে অভিভাবকেরা নির্লিপ্ত। একটি প্রজন্ম জন্ম নিচ্ছে ধোঁয়ার মায়াজালে, যেখানে বিষ আর স্টাইল এক হয়ে গেছে। একজন মা যখন বাচ্চাকে স্কুলে দিয়ে ফিরে এসে বিড়ির ধোঁয়ায় স্বস্তি খোঁজেন, তখন বুঝে নিতে হয়-এটি শুধুমাত্র অভ্যাস নয়, এটি একটি জাতীয় মনস্তত্ত্বের ব্যাধি।
‘তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি’
২০২৫ সালের বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবসের প্রতিপাদ্য অত্যন্ত সময়োপযোগী: “তামাক কোম্পানির কূটকৌশল উন্মোচন করি, তামাক ও নিকোটিনমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি।”
এই প্রতিপাদ্যের মূল বার্তা হলো, ‘অন্তর্জালে নয়, মাঠে-মাঠে প্রতিরোধ গড়ি।’ শুধু সচেতনতামূলক ব্যানার বা আলোচনায় নয়, বাস্তবিক পরিবর্তন আনতে হলে প্রয়োজন-
১. কঠোর আইন বাস্তবায়ন
২. রাজনৈতিক সদিচ্ছা
৩. কর্পোরেট জবাবদিহিতা
৪. নাগরিক অংশগ্রহণ
৫. শিক্ষাব্যবস্থায় বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ
কী করতে হবে এখনই?
তামাকপণ্যে শুল্ক ও কর বাড়াতে হবে, যাতে সস্তায় পণ্য পাওয়া না যায়।
স্কুল ও কলেজে বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য শিক্ষার অংশ করা হোক তামাকের ভয়াবহতা।
তামাক কোম্পানির বিজ্ঞাপন, স্পন্সরশিপ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।
স্থানীয় প্রশাসনকে দায়বদ্ধ করা হোক আইন প্রয়োগে।
ই-সিগারেট, হিটেড টোব্যাকো, ফ্লেভার্ড নিকোটিন পণ্যের বাজারজাতকরণ বন্ধ করতে হবে।
জনগণের অংশগ্রহণে গড়ে তুলতে হবে স্থানীয় তামাকবিরোধী কমিটি।
একটি ধোঁয়াহীন ভোরের অপেক্ষায়
এই লেখার মূল উদ্দেশ্য তামাকবিরোধী স্লোগান নয়, বরং সেই ঘুমন্ত রাষ্ট্রচিন্তার উপর কড়া নক দেওয়া—যেখানে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে শত শত মানুষ, অথচ বিক্রি হচ্ছে বিষকে “ফ্যাশন” হিসেবে। তামাক এখন কেবল ব্যক্তির ক্ষতি নয়, এটি জাতির স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ ভাবনার একটি সংকট।
আমরা যদি চাই, একটি স্বাস্থ্যবান, ন্যায্য এবং টেকসই বাংলাদেশ, তাহলে ধোঁয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ এখনই শুরু করতে হবে-পূর্বসূরিদের ভুলের ধুলো ঝেড়ে নিয়ে, ভবিষ্যতের জন্য সাফ এক প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রত্যয়ে।
আজ নয়, এখনই সময়।
লেখকঃ কলামিস্ট,সোস্যাল এক্টিভিস্ট।