এস এম আজাদ হোসেন: ‘মানুষের ঘাম যখন শ্রমে পরিণত হয়, তখন তার মর্যাদা দেওয়াটাই সভ্যতার শিষ্টাচার।’
এই বাক্যটি শুধু একটি মূল্যবোধ নয়, বরং সভ্যতার প্রতিটি উন্নত স্তম্ভের ভিত। সেই ভিতকে মজবুত করার লক্ষ্যে শ্রমিক শ্রেণির যে আত্মত্যাগ, প্রতিবাদ আর রক্তের রেখায় আঁকা হয়-তাতেই জন্ম নেয় মে দিবস, আর তার চেতনাই গড়ে তোলে সামাজিক ন্যায়ের দাবিকে সুদৃঢ়।
মে দিবসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মে দিবসের সূচনা হয় ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে আয়োজিত বিশাল ধর্মঘট থেকে। শ্রমিকরা তখন দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত শ্রম দিতেন, বিনিময়ে ছিল নগণ্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা, আর অসহনীয় জীবনমান।
৩ মে হেইমার্কেট স্কয়ারে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সময় পুলিশ গুলি চালায়। প্রাণ হারান বহু শ্রমিক। পরদিন ৪ মে ‘হেইমার্কেট ম্যাসাকার’ হিসেবে পরিচিত ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটে। অজ্ঞাত বোমা বিস্ফোরণের দায়ে কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে প্রমাণিত হয় তারা ছিলেন নির্দোষ। এই রক্তের বিনিময়ে ১৮৮9 সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১ মে বিশ্বব্যাপী শ্রমিক সংহতির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশের শ্রম-বাস্তবতা: স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও প্রশ্নে প্রশ্ন
বাংলাদেশ একটি শ্রমনির্ভর রাষ্ট্র। আমাদের অর্থনীতির দুই বড় খাত-পোশাকশিল্প এবং রেমিট্যান্স মূলত শ্রমিকদের ঘামেই গড়া। অথচ, এই শ্রমিকরাই এখনও সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত, বঞ্চিত ও উপেক্ষিত।
বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে প্রায় ৪০ লক্ষ শ্রমিক কাজ করে, যাদের ৮৫ শতাংশই নারী। এই খাত থেকে প্রতিবছর ৪৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি আয় আসে। অথচ, শ্রমিকরা এখনও ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ, ইউনিয়ন গঠন ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস ছিল এক নির্মম ট্র্যাজেডি। ১১৩৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু আর হাজারো পঙ্গুত্বের বিনিময়ে সেসময় গোটা বিশ্বে আলোচনায় আসে আমাদের শ্রমিক বাস্তবতা। এরপর কিছু সংস্কার এলেও মূল সমস্যা রয়ে গেছে একই-শ্রমিকের কথা শ্রম বাজারে কম, মালিকের কথাই বড়।
শ্রমিকের জীবনযাত্রা বনাম অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিঃ
বাংলাদেশে গত দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার প্রশংসনীয় হলেও প্রশ্ন থাকে-এর সুফল কারা পাচ্ছে?
২০২৪ সালে গার্মেন্ট শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ১২,৫০০ টাকা। অথচ ঢাকার মতো শহরে মাথাপিছু খরচ দৈনিক ৫০০ টাকা না হলে চলা সম্ভব নয়। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা ও সন্তানদের শিক্ষা-সব মিলিয়ে একজন শ্রমিকের জন্য এই আয় পর্যাপ্ত নয়। এটা পরোক্ষ শোষণ নয় তো কী?
শ্রম আইনের সীমাবদ্ধতা ও বাস্তবায়নের দুর্বলতা
বাংলাদেশে বর্তমানে শ্রম আইন ২০০৬ (সংশোধিত ২০১৮) বলবৎ রয়েছে। কিন্তু এই আইন বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন আছে বিস্তর। ইউনিয়ন গঠনের সুযোগ থাকলেও বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই মালিক পক্ষ তা দমন করে। লেবার কোর্টের মামলা নিষ্পত্তি বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না।
বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাত—যেখানে মোট শ্রমিকের প্রায় ৮৫% নিয়োজিত—তাদের অধিকারের বাস্তব রক্ষণাবেক্ষণ অত্যন্ত দুর্বল। বাসচালক, নির্মাণ শ্রমিক, কৃষিকর্মী কিংবা গৃহকর্মী-তাদের নিরাপত্তা নেই, শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ নেই, সামাজিক সুরক্ষা নেই।
ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্রমিক: চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
নতুন অর্থনীতির এক বাস্তবতা হলো গিগ ইকোনমি। রাইড-শেয়ারিং, ফুড ডেলিভারি, ফ্রিল্যান্সিংসহ অনেক খাতেই তরুণরা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে কর্মঘণ্টা, মজুরি কাঠামো, দুর্ঘটনা বীমা ও সামাজিক নিরাপত্তা নেই বললেই চলে।
এই খাতগুলোতে শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় পৃথক নীতিমালা তৈরি ও বাস্তবায়ন জরুরি। শুধু শ্রম নয়, প্রযুক্তিনির্ভর শ্রমের ক্ষেত্রেও শ্রমিক সংহতি গড়ে তোলার সময় এসেছে।
মে দিবসের চেতনা: কেবল স্মারক নয়, প্রতিরোধের আহ্বান
প্রতিবছর মে দিবসে র্যালি, সেমিনার, গান-কবিতা হয়, নেতারা বক্তৃতা দেন। কিন্তু চেতনা তখনই প্রাসঙ্গিক, যখন তা নীতিতে রূপ নেয়, আইনে প্রতিফলিত হয়, বাস্তবে জীবন্ত হয়।
মে দিবস আমাদের শেখায়-শ্রম কোনো করুণা নয়, এটি অধিকার। শ্রমিকদের রক্তে কেনা অধিকার নিয়ে উদযাপন নয়, পুনরুদ্ধারের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
করণীয়: একটি সর্বজনীন শ্রমনীতি ও দায়িত্বশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা
১. ন্যায্য মজুরি বাস্তবায়ন: প্রতিটি খাতে শ্রমিকের জন্য জীবনধারনযোগ্য মজুরি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
২. সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ: দুর্ঘটনা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, পেনশন, স্বাস্থ্যসেবা-এসব মৌলিক সুবিধা আইনত বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩. গিগ ও ডিজিটাল শ্রমনীতির প্রণয়ন: নতুন খাতগুলোতে শ্রমিক অধিকার রক্ষায় আইনি কাঠামো গড়া প্রয়োজন।
৪. শ্রমিকের সংগঠিত হওয়ার অধিকার: ইউনিয়ন গঠনে প্রতিবন্ধকতা দূর করতে প্রশাসনিক সহায়তা ও শ্রমিকবান্ধব নীতি নিতে হবে।
৫. নারী শ্রমিকের বিশেষ সুরক্ষা: কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ, ডে-কেয়ার, মাতৃত্বকালীন সুবিধা-এসব বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।
শেষ কথা
মে দিবস কোনো ফ্যাশন নয়, এটি শ্রমজীবী মানুষের রক্তাক্ত ইতিহাস। বাংলাদেশে আজও শ্রমিকের ঘাম যেমন সোনার ফসল ফলায়, তেমনি তা মালিকের রাজত্ব গড়ার হাতিয়ার হয়।
এই লেখার মাধ্যমে আমি বলতে চাই-শ্রমিক শুধু মেশিন চালায় না, সে সভ্যতার ইঞ্জিন। তার মর্যাদা দেওয়া মানেই জাতির উন্নয়নকে টেকসই করা।
এই মে দিবসে প্রতিজ্ঞা হোক-আমরা কেবল স্মরণ করব না, রূপান্তর ঘটাব।
লেখক-কলামিস্ট,সমাজকর্মী।