English

24 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, মার্চ ২৮, ২০২৪
- Advertisement -

একটা জীবনের শেষ এভাবেই: আজ যদি মাথায় হেলমেটটা থাকতো…

- Advertisements -

সেদিন ছিলো ১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১।
ঠিক কি বার ছিলো সেটা আমার মনে নেই।আমি রংপুর থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলাম ঠিক ১০ টার বাসে।বাস পেয়েছিলাম খুব সহজেই।কিন্তু বাসের মধ্যে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত ছিলো না।কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বসার মত একটা জায়গা পেয়ে গিয়েছিলাম।

ও আচ্ছা আমাদের বাসা কোথায় সেটাই তো জানানো হলো না।আমাদের বাসা ডিমলা নামক ছোট একটি উপজেলা শহরে।যে শহরের চারপাশ ঘেরা চোঁখ জুড়ানো সবুজ শস্য দিয়ে,গাছপালা দিয়ে।অবশ্য বাসের মধ্যে জানালার ধারে বসলে সেই দৃশ্য খুব সহজেই উপভোগ করা যায়।
বাসায় পৌঁঁছে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে পিচ্চির সাথে খেলছিলাম।পিচ্চি হলো আমাদের বাসার সর্বকনিষ্ঠ্য সদস্য।মেজো ভাইয়ের মেয়ে।খেলা শেষ করে শুয়ে রেস্ট নিচ্ছিলাম।

কিছুক্ষণ যেতেই হঠাতই কিছু কথা কানে আসছিলো।এটা বুঝতে পেরেছিলাম যে বারান্দায় আব্বু,আম্মু,ভাইয়া কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে।আমি শুয়ে না থেকে বাইরে বেড়িয়ে গেলাম।আমাকে দেখেই ভাইয়া বলে উঠলো বড় আব্বুর ছেলে আমার কাজিন নাকি একটু আগে বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।অবস্থা খুব একটা ভালো না তাই আমাদের এখানে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে এসেছে।

এদিকে আমার তখনও মনে হচ্ছিলো ধুরু কিছু হবে না।কত জনই তো বাইক এক্সিডেন্ট করে,আবার ঠিকও হয়ে যায়।
ভাইয়া তরিঘরি করে বেড়িয়ে গেলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।ভাইয়া ওখানে যাওয়ার পরে যখন ফোন দিয়ে বললো যে এখানে চিকিৎসা হবে না, ডাক্তার চিকিৎসার জন্যে রংপুরে যেতে বলেছে তখন অনেকটাই চিন্তা হতে লাগলো।কিছুক্ষণ পর ভাইয়া হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরলো।কিন্তু কিছু বলছিলো না।শুধু বললো রংপুরে নিয়ে গিয়েছে সব ঠিক হয়ে যাবে।এই কথা শুনে কিছুটা স্বস্তি আসলো সবার মাঝে।কিন্তু ভাইয়া আমাকে পরে যা বললো সেটা শুনে আমি আর আমার মধ্যে ছিলাম না।আম্মুর সামনে তেমন কিছু বলে নি।কারণ আম্মু স্ট্রোক করা মানুষ এইসব নিতে পারবে না।আমি কিন্তু তখনো জানিনা বাইক এক্সিডেন্ট হলো কিভাবে।

ভাইয়ার কাছে যা শুনেছিলাম সেটা হচ্ছে,দুটো বাইক মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিলো।আমার কাজিনের মাথায় হেলমেট ছিলো না।কিন্তু অপরজনের মাথায় হেলমেট ছিলো।অপরজনের আঘাত ততটাও গুরুতর ছিলো না।কিন্তু পুরো এক্সিডেন্টটাই আমার কাজিনের মাথার উপরে দিয়ে গিয়েছে।নাকের হাড়টা নাকি অর্ধেক নাকের বাইরে বেড়িয়ে এসেছিলো আর বাকি অর্ধেক পুরো মস্তিষ্কে আঘাত হানে।চোঁখ দুটো সে মুহুর্তেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
(আমার এইসব লিখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে। আল্লাহ্ না করুক আজ যদি মাথায় হেলমেটটা থাকতো!!!)

এখানকার মানুষজন ওর অবস্থা দেখেই বলে দিয়েছিলো বাঁচানো সম্ভব না।তবুও মানুষ বলে না,আশায় বাঁচে প্রাণ।
সেদিনের রাতটা কিভাবে কেটেছে বলে বুঝাতে পারবো না।আম্মু এত কিছু জানতো না।আম্মুকে জানানো হয় নি।আর হ্যাঁ সবথেকে দুঃখজনক ব্যাপারটা কি জানেন,আমার কাজিনের বউ সন্তান সম্ভাব্য ছিলো। ২/১ দিনের মধ্যেই বাচ্চা প্রসব করবে।

রাত ৩ টা, ফোন বাজছে।
এত রাতে চাচ্চুর ফোন পেয়ে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।অজানা একটা ভয় কাজ করছিলো।হাত কাঁপছে,শরীর কাঁপছে,ফোন ধরে কন্ঠে জড়তা কাজ করছিলো,আওয়াজ বের হচ্ছিলো না।অপর পাশের মানুষটা হ্যালো বলেই ভারী কন্ঠে বলে উঠলো বাবু আর নেই(আমার কাজিনের ডাক নাম বাবু)।
আমি থরথরে কাঁপতেছিলাম কি করবো বুঝতেছিলাম না।আমার চোঁখের সামনে শুধুই আমাদের শৈশব স্মৃতিগুলো ভেসে উঠতেছিলো।
আমি কাউকে কিছু বলার মত অবস্থায় ছিলাম না। আমি নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছিলাম।

কিছু সময় যেতেই বাসার সবাই জেনে যায়।বাসার পরিবেশ অনেক ভারী হয়ে উঠেছিলো।আর হ্যাঁ আমার কাজিনরা কিন্তু গ্রামে থাকে।আর আমরা একটু দূরে থাকি।

সবাই শুধু সকাল হবার অপেক্ষায় আছি।আর আম্মুকে সামলাতে হচ্ছে। কারণ আম্মু আমার কাজিনকে খুব ভালোবাসতো। আমি নিজেই নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না আর আম্মুকে কিভাবে সামলাবো।ভাবী আম্মুকে সামলাচ্ছিলো।আব্বু,ভাইয়া এদের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না।
আমরা নিজেদের সামলে নিয়ে সকাল সকাল রওনা দিলাম গ্রামের বাসার উদ্দেশ্যে।

বেলা ১১ টা লাশ তখনও বাড়িতে আসে নি।বড় আম্মুর দিকে তাকাতেই দেখতে পেলাম বেচারি সন্তান হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছে।বাড়িময় শুধু মানুষ আর মানুষ।শুধু একটি লাশের অপেক্ষায়।দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতেছে।পরিবেশ ততই ভারী হচ্ছে।কেউ কাঁদছে,আবার কেউ শান্তনা দিচ্ছে।

আমি কিছু না ভেবেই কাজিনের ঘরে চলে গেলাম।সেখানে গিয়ে দেখি অনেক মহিলারা কাজিনের বউয়ের পাশে বসে আছে।আর কাজিনের বউ চোঁখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। সেখানে ফুফুও ছিলো। মেয়েটা শোকে পাথর হয়ে গিয়েছে।আজ বাদে কাল যে মেয়েটা মা হবে সেই মেয়েটার স্বামীকে আল্লাহ্ এভাবে কেড়ে নিলেন। বাচ্চাটা জন্মানোর আগেই তার বাবাকে হারালো। মেয়েটা কাঁদতে পর্যন্ত পারছিলো না। বিয়ের দুবছর যেতে না যেতেই কি থেকে কি হয়ে গেলো।

দুপুর ১২ টা, লাশ এসে গেছে।
কি অদ্ভুত তাইনা।মৃত্যুর পর নিজের নামটাও আর থাকে না।
লাশের শেষ গোসল হয়ে গিয়েছে।সবাই এক এক করে দেখছিলো আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছিলো।কিন্তু আমার কেনো জানি সাহস হচ্ছিলো না দেখার।সাহস করে যেই না দেখলাম হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।লাশ দেখে মনে হচ্ছিলো কি সুন্দর ঘুমাচ্ছে ছেলেটা।চারপাশে শুধু ব্যান্ডেজ আর ব্যান্ডেজ।কতটা কষ্ট পেয়ে ছেলেটা আজ দুনিয়া ছাড়লো ভাবতেই অঝোরে চোঁখের পানি পড়ছে।

শেষ মুহুর্তে এসে যখন তার বউকে তার কাছে নিয়ে আসা হলো তখনো না মেয়েটা শুধু তাকিয়েই ছিলো।তার মনের অবস্থাটা কেউ অনুভব করতে পারবে না।বড় আব্বুকেও দেখছিলাম কান্না চেপে রাখার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন।

শেষ বিদায়,,,,আতর,গোলাপজল মেখে লাশ দাফনের জন্যে তৈরী। আর আপনজনদের আহাজারি ক্রমেই বেড়েই চলছিলো। আমিও নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না। সবাই কাঁদছে। ভাই-বোন, চাচা -চাচী,খালা-মামা,আশেপাশের মানুষ সবাই শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশটা মনে হয় একটু বেশিই ভারী হয়ে উঠে তাইনা।এত ভালো একটা ছেলের আয়ু মাত্র এ কদিন লিখেছিলেন উপরওয়ালা।সে মাদ্রাসা থেকে পড়াশুনো করেছিলো।মাঝেমধ্যে ইমাম না থাকলে সে নিজেই ইমামতি করতো।সে তো খুব ভালোই বাইক চালাতো।তার তো এরকম এক্সিডেন্ট হবার কথা ছিলো না।
সাদা কাফনে জড়ানো লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চিরবিদায়ের জন্যে।

দাফন শেষে যে যার মত নিজেদের ঠিকানায় চলে আসসাল।
পরেরদিন জানতে পারলাম লাশটা আজ বাবা হয়েছে। তার ছেলে সন্তান হয়েছে। নিজের অজান্তেই চোঁখ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।
বাচ্চাটা তার বাবাকে দেখার সৌভাগ্য পেলো না।মেয়েটা পেলো না স্বামী সৌভাগ্য। লাশটা পেলো না তার সন্তানকে এক পলক দেখার সুযোগ।
তবে হ্যাঁ অবশ্যই সে ওপাড় থেকে দেখছে সব।

বাচ্চাটা হওয়ার সময় অনেক দুর্বল হয়েছিলো। বাচ্চাটা এখন ভালো আছে।কিন্তু বাবার অভাব কে পূরণ করবে। মায়ের মনের অবস্থাটা কে বুঝবে। বাবা হারা সন্তানদের জন্যে দুনিয়াটা অনেক কঠিন হয়।

একটা জীবনের শেষ এভাবেই!!!
নিজের পরিবারের কথা ভেবে হলেও সবাই সাবধানে চলাফেরা করবেন। অবশ্যই হেলমেট পরিধান করে বাইক চালাবেন।

নাম: আরশি জাহান
ঠিকানাঃ রংপুর
পেশাঃ শিক্ষার্থী (বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর)

সাবস্ক্রাইব
Notify of
guest
0 মন্তব্য
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন