English

32.9 C
Dhaka
বৃহস্পতিবার, জুন ২৬, ২০২৫
- Advertisement -

আমাদের বাংলা গানের সুকণ্ঠী গায়িকা নার্গিস পারভীন

- Advertisements -

এ কে আজাদ: নার্গিস পারভীন। কণ্ঠশিল্পী। ৭০-৮০ দশকের বেতার ও টেলিভিশনের খুবই জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ছিলেন নার্গিস পারভীন। অসংখ্য কালজয়ী জনপ্রিয় বাংলা গানে কন্ঠ দিয়েছেন। এক সময়ে রেডিও-টেলিভিশনে দর্শকশ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতো তাঁর গাওয়া গান। তাঁর জাদুমাখা কন্ঠের সুরে সুরে মুগ্ধতায় ভরে যেতো শ্রোতাদের হৃদয়-মন।

অসাধারণ প্রতিভাময়ী একজন কণ্ঠশিল্পী ছিলেন নার্গিস পারভীন। ছিলেন সুরেলা কন্ঠের অধিকারী। ছিলেন বিস্ময়কর সুকন্ঠী শিল্পী। সেই সময়ে, মেধা-নিষ্ঠা ও অসামান্য প্রতিভার গুণে, তাঁর গাওয়া গান বাংলার ঘরে ঘরে পৌঁছে গিয়েছিল। একেরপর এক উপহার দিয়েছেন মানুষের হৃদয়ভূমিতে নাড়া দেয়া, কালোত্তীর্ণ সব গান। তিনি আজীবন সাধনা করে গেছেন সুদ্ধসংগীতের, মৌলিক বাংলা গানের।
নিভৃতচারী, বরেণ্য কন্ঠশিল্পী নার্গিস পারভীন গান গাওয়াটাকেই জীবনের ধ্যান ও জ্ঞান হিসেবে নিয়েছিলেন। এই সৃজনশীল মানুষটি খ্যাতির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন সারাজীবন।
আমাদের বাংলা গানের সুকণ্ঠী গায়িকা নার্গিস পারভীনের মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, কুষ্টিয়ায় নিজ বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। প্রয়াত এই গুণি কন্ঠশিল্পীর স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।

নার্গিস পারভীন ১৯৪৭ সালের ১৩ আগষ্ট, কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মাহতাব উদ্দিন ছিলেন আইনজীবী, বড় ভাই ও বাবা গান করতেন শখের বশে, তাই পরিবারে একটা সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করত। সেই আবহে তিনিও ঝুঁকে পরেন গানের দিকে, মূলত বড় ভাই ও বাবার অনুপ্রেরণাতেই শৈশব থেকেই সংগীত চর্চার সঙ্গে বেড়ে ওঠেন নার্গিস পারভীন।

১৯৭২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই, রাজশাহী বেতার-এ গান করেছেন।

১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর বিয়ে করেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষককে। নার্গিস পারভীন বিসিআইসিতে উচ্চ পদে চাকুরী করেছেন।

১৯৭৪ সাল থেকে ঢাকা বেতার-এ গান গাওয়া শুরু করেন নার্গিস পারভীন। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁর উত্থান শুরু হয় ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে । পুরো ৮০ দশক জুড়ে বেতার ও টেলিভিশনে গাওয়া তাঁর গানগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নার্গিস পারভীনও তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সব ধরণের দর্শক-শ্রোতাদের কাছে।

বেতার-এ তাঁর গান শুনে প্রখ্যাত সুরকার আলম খান, নার্গিস পারভীনকে সুযোগ করে দেন চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার। আলম খান এর সুর ও সঙ্গীতে ‘কন্যাবদল’ চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে অভিষেক হয় নার্গিস পারভীনের।

আবুল বাশার পরিচালিত ‘কন্যাবদল’ চলচ্চিত্রটি মুক্তিপায় ১৯৭৯ সালে। চলচ্চিত্রের প্রথম গানেই তিনি জনপ্রিয়তা পান, প্রশংসিত হন সূধীমহলে। নার্গিস পারভীন অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। তিনি যেসব চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন তারমধ্যে- কন্যাবদল, ভালো মানুষ, প্রিন্সেস টিনা খান, শাস্তি, সমর্পণ, ভাগ্যবতি, উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও নার্গিস পারভীন, বেতার ও টেলিভিশনের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চিত্রের জিঙ্গেলেও কন্ঠ দিয়েছিলেন ।

নার্গিস পারভীনের গাওয়া কিছু কালজয়ী জনপ্রিয় গান- ভালবাসা দিয়ে মোরে এতো সুখ দিয়েছ, চাই না আর কিছু চাই না…., তোমাকে ভালবাসি সে আমার অহংকার…,পোড়া চোখ কেন তুই অন্ধ থাকিস না…, আমার চোখে রাত্রি থাকুক… ময়ুর মহলেও আমার মন বসবে না…,মনে আমার এ কোন ভাবনা…, যে আমার হৃদয় করলো চুরি…, তোমার দেয়া ভালোবাসা…., চলো না কোথাও নিরিবিলি…, মাধবী রাতে সুনীল মায়া…., মিথ্যে সুখের গান গেয়ে…, কংলক আর বেঁচে রবে কতদিন…., এদেশ আমার সবুজে সবুজ…., আমি তো কেবলই এক…., তোমাকে বিদায় দিয়ে শ্রাবনের….., অমাবস্যা পূর্ণিমা কোনটা ভালো…., পাখির কন্ঠে গান…., কাগজের ফুল নয় দু’চোখের ভূল নয়…., কতোদিন আর কাঁদবো বলো…., চাইনা কিছু চাইনা আমার আছে লক্ষী সোনা…., বড় বেশি দেরি হয়ে গেছে আর ফেরার সময়তো নেই….বুঝিনা তাঁর নীরব মনের কিসে এমন বায়না….,বন বাতাসের ছন্দে দোলানো…., সজনী প্রেম হলো বেদনা…, দুটি মন আর দুটি জীবন…, এই পথ যদি হতো শান্ত নদী…, ভালোবাসার উল্টো পিঠে ঘৃণা থাকে কিনা আমি জানি না…., আমার এই আলতা পরা পা…., প্রভৃতি।

অসংখ্য কালজয়ী জনপ্রিয় গানের কন্ঠশিল্পী নার্গিস পারভীন। যিনি বাংলা মৌলিক গানকে পৌঁছে দিয়েছে অনন্য এক উচ্চতায়। সত্তর-আশি দশকে, বেতার ও টেলিভিশনে বাংলা গানের অপরিহার্য্য এক কন্ঠশিল্পী ছিলেন তিনি।

সে সময়ে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তাঁর মায়াময় সুমধুর কন্ঠগুণে। তাঁর কন্ঠে উপমহাদেশের কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছাঁয়া খুঁজে পেতেন সেই সময়ের সঙ্গীতপ্রেমীরা। এই অদ্ভুত সাদৃশ্যের ব্যাপারটি ছিল নিতান্তই প্রকৃতিগত এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত।

এই প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী তাঁর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাকে পিছনে ফেলে এক সময় স্বামীর সাথে বিদেশে চলে যান। কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে আসেন তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। দেশে এসে আবারও গানের জগতে মনোনিবেশ করেন। এক পর্যায়ে স্বামীর সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরবর্তি সময়ে একমাত্র ছেলেটাও বিদেশে চলে যায়। সে সময়টায়, লাখো-কোটি দর্শকশ্রোতার কাঙ্খিত কণ্ঠশিল্পী নার্গিস পারভীন একেবারেই একা হয়ে যান। জীবনভর যিনি, তাঁর বৈচিত্র্যময়-হৃদয়গ্রাহী সুরেলা কন্ঠের মূর্ছনায় মানুষের মন রাঙিয়েছেন, তাঁর নিজের জীবনের রঙ ফ্যাকাসে হয়েছে কখন, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেননি। সুখ-সুরের মূর্ছনায় রাঙাতে পারেননি নিজের জীবন ।

নব্বই দশকের শেষের দিকে তিনি গানের জগত থেকে একেবারেই দূরে সড়ে যান। এক সময়, গুণী এই কন্ঠশিল্পীর জীবনে দেখা দেয় নতুন আরেক অধ্যায়ের। একাকি নিঃসঙ্গ জীবনে শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যধি ক্যানসার। মরণব্যধি ক্যানসারের সাথে লড়াই করতে করতে পরাজয় বরণ করেন, আমাদের বাংলা গানের জগতে খ্যাতি অর্জন করা অসাধারণ প্রতিভাময়ী কণ্ঠশিল্পী নার্গিস পারভীন।

নার্গিস পারভীন নামে আমাদের একজন অসাধারণ প্রতিভাময়ী ও জনপ্রিয় কন্ঠশিল্পী ছিলেন- একথা হয়তো আজকের এই প্রজন্মের অধিকাংশ কন্ঠশিল্পী বা দর্শকশ্রোতা জানেনই-না। এই দুর্ভাগ্য আমাদেরই, আমরা নার্গিস পারভীন এর মতো এমন একজন মেধাবী কন্ঠশিল্পীকে ভুলে গেছি, ভুলে গেছি বাংলা গানে তাঁর অবদানের কথা।

আমরা দিতে পারিনি এই শিল্পীর যোগ্য সন্মান।

নার্গিস পারভীন শারীরিকভাবে আজ এই পৃথিবীতে বেচেঁ নেই। কিন্তু আছে তাঁর সৃষ্টি, আছে তাঁর গাওয়া গান, যা থাকবে অনন্তকাল। তাঁর এই মোহনীয় সুরেলা কন্ঠের গানের মূর্ছনায়, কণ্ঠশিল্পী নার্গিস পারভীনও বেঁচে থাকবেন- অনন্তকাল ।

The short URL of the present article is: https://www.nirapadnews.com/4vp9
Notify of
guest
0 মন্তব্য
সবচেয়ে পুরাতন
সবচেয়ে নতুন Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Advertisements
সর্বশেষ
- Advertisements -
এ বিভাগে আরো দেখুন