এস এম আজাদ হোসেন: বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা যেন এক নিত্যনৈমিত্তিক ট্র্যাজেডি। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো প্রান্তে প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। রক্তে ভেজা পিচঢালা সড়ক এখন আর খবর নয়, বরং নিয়মিত বাস্তবতা। দুর্ঘটনার সংখ্যা যতই বাড়ছে, ততই কমছে জনসচেতনতা, নীতিনির্ধারকদের দায়বোধ এবং রাষ্ট্রের কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২,৮০০ জন, আহত হয়েছেন প্রায় ৫,০০০ জন। এর মধ্যে জুন মাসেই মৃত্যু হয়েছে ৫১০ জনের, যা গত বছরের তুলনায় ১২ শতাংশ বেশি। অথচ সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে বহু আলোচনা, সভা-সেমিনার হয়; আইন হয়, প্রকল্প নেওয়া হয়-কিন্তু দুর্ঘটনার গতি রোধ হয় না।
বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই অদক্ষতার শিকার। রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩০ লাখ যানবাহন চলাচল করে। কিন্তু এর ৪০ শতাংশই ফিটনেসবিহীন বা লাইসেন্সহীন। একই চিত্র দেখা যায় জেলা ও উপজেলা সড়কগুলোতেও। মহাসড়কে হাইস্পিড বাস, ট্রাক আর বাইকের প্রতিযোগিতা যেন অলিখিত ‘মৃত্যু রেস’। চালকের অদক্ষতা, মাত্রাতিরিক্ত গতি, যত্রতত্র ওভারটেকিং-সব মিলে সড়ককে করে তুলেছে ভয়াবহ।
বিশেষ করে ঈদ, পূজা বা ছুটির মৌসুমে এই ট্র্যাজেডি আরও প্রকট আকার ধারণ করে। ২০২৫ সালের ঈদুল আজহার সময়ে মাত্র ১৫ দিনে ৪২০ জনের মৃত্যু এবং ৭০০ জনের বেশি আহত হওয়ার তথ্য আতঙ্কিত করে তুলেছে গোটা জাতিকে। পরিবারের আনন্দযাত্রা কেবল কয়েক সেকেন্ডেই পরিণত হয় শোকযাত্রায়।
বাংলাদেশের সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো-অব্যবস্থাপনা। নতুন সড়ক নির্মাণ, সেতু, ফ্লাইওভার-সব কিছুতেই রয়েছে নির্মাণ ত্রুটি, দুর্নীতি ও তদারকির অভাব। সড়ক নির্মাণে গুণগতমান নিশ্চিত না হওয়ায় অল্পতেই গর্ত, ফাটল বা ধস নামে। সড়কে নেই সঠিক সাইনেজ, নেই রোড মার্কিং, নেই নিয়ন্ত্রিত জেব্রা ক্রসিং বা ইউটার্ন।
বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) ও হাইওয়ে পুলিশের মধ্যে দায়িত্বের সুষ্পষ্ট বিভাজন না থাকায় আইনের প্রয়োগ দুর্বল। অনেকে ঘুষ দিয়ে ফিটনেস ছাড়পত্র ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিচ্ছেন-যা একটি বড় অনিয়মের চক্র। চালকের দক্ষতা যাচাই না করে কেবল ফরমাল পদ্ধতিতে অনুমোদন দেওয়া সড়ক নিরাপত্তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
অবশ্য চালকদের দোষই সব নয়। দিনের পর দিন ১৬–১৮ ঘণ্টা গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। বিশ্রাম নেই, স্বাস্থ্যপরীক্ষা নেই, মনিটরিং নেই। মালিকদের চাপ, অপ্রতুল মজুরি, প্রতিযোগিতা-সব মিলিয়ে চালকরা প্রায় এক মানববোমার মতো সড়কে নামেন। একটি ভুল সিদ্ধান্তেই ঘটতে পারে ভয়াবহ বিপর্যয়।
তাছাড়া, চালকদের প্রশিক্ষণের মান, লাইসেন্স পদ্ধতির স্বচ্ছতা এবং স্বাস্থ্যগত যোগ্যতা পরীক্ষার অভাব পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে বরিশালের একটি দুর্ঘটনায় চালকের পা অবশ ছিল বলে প্রমাণ মেলে। অথচ তার লাইসেন্স ছিল বৈধ। প্রশ্ন হলো-কে যাচাই করল তার শারীরিক সক্ষমতা?
অপরদিকে, যাত্রীরাও অনেক সময় নিজেরাই নিজের বিপদের কারণ হন। হেলমেট না পরা, রাস্তা পারাপারে নিয়ম না মানা, চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দেওয়া, বাসে ওঠা-নামার সময় অসতর্কতা-এসবকিছুই দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। ট্রাফিক আইন মানার প্রবণতা কম, দায়সারা মনোভাব বেশি। স্কুল-কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ট্রাফিক সচেতনতা কার্যক্রম এখনও পর্যাপ্ত নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সড়ক নিরাপত্তায় প্রযুক্তি ব্যবহারের দাবি উঠেছে জোরালোভাবে। ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে সিসিটিভি, স্পিড ক্যামেরা, জিপিএস ট্র্যাকিং-এই ব্যবস্থা চালু হলেও তা খুবই সীমিত। বিআরটিএ-এর ডিজিটাল লাইসেন্স যাচাই ব্যবস্থা বা যানবাহনের ডাটাবেইজ এখনও ত্রুটিপূর্ণ ও অপর্যাপ্ত। অনলাইন জরিমানা ব্যবস্থা বা অটোমেটেড ট্রাফিক আইন প্রয়োগ এখনো বিস্তৃত হয়নি।
তবে ২০২৫ সালে নতুন ‘ডিজিটাল ট্রাফিক মনিটরিং’ পাইলট প্রকল্প শুরু হয়েছে ঢাকা ও চট্টগ্রামে, যেখানে চালকের লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এবং স্পিড রেকর্ড স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ড হচ্ছে। এই প্রকল্প সফল হলে ভবিষ্যতে দেশব্যাপী সম্প্রসারণের সম্ভাবনা রয়েছে।
চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের দীর্ঘদিনের দাবী এবং ২০১৮ সালের আলোচিত ‘নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের’ পর সরকার ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ কার্যকর করলেও তার প্রয়োগ এখনও অপ্রতুল। এই আইনে কঠোর শাস্তির বিধান থাকলেও অনেক সময় মামলা হয় না, তদন্ত হয় না, বিচার হয় না। পুলিশ প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং মালিক-শ্রমিক সংগঠনের চাপে তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
মামলার দীর্ঘসূত্রতা, সাক্ষী সংকট ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে অনেক সড়ক দুর্ঘটনার মামলাই শেষ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয় না। ফলে চালক বা মালিকরা বিচারহীনতার সুবিধা নিয়ে আবারো একই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে ২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলন এক যুগান্তকারী ঘটনা ছিল। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়-তার স্থায়ী ফলাফল কী? আন্দোলনের সময় নেওয়া প্রতিশ্রুতি, উদ্যোগ, আইন প্রণয়ন-সবই আজ ধোঁয়াশায়। আন্দোলনের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় সাত বছর, কিন্তু স্কুলগামী রাফির মতো শত শিশুর মৃত্যু থামেনি।
নাগরিক সমাজ, সাংবাদিকতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও নিরাপদ সড়কের সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমবেদনা বা ক্ষোভ দেখা গেলেও দীর্ঘমেয়াদি কোনো উদ্যোগ দেখা যায় না।
সড়ক দুর্ঘটনারোধে বাস্তবভিত্তিক কিছু প্রস্তাবনাঃ
১) চালকের দক্ষতা যাচাই ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বছরে একবার মেডিকেল টেস্ট বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
২) সড়কের ডিজাইন ও নির্মাণে মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নতুন প্রকল্পে ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও সেফটি অডিট বাধ্যতামূলক করতে হবে।
৩) ট্রাফিক আইন অটোমেটেড পদ্ধতিতে প্রয়োগ করতে হবে-স্পিড ক্যামেরা, ট্রাফিক সেন্সর, জিপিএস মনিটরিং চালু করে।
৪) জনসচেতনতা বাড়াতে স্কুল-কলেজে ট্রাফিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘সড়ক নিরাপত্তা ক্লাব’ গঠনের নির্দেশনা দেওয়া যেতে পারে।
৫) নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচার প্রক্রিয়া চালু করা জরুরি। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটনায় তদন্ত ও ট্রাইব্যুনাল কার্যকর করতে হবে।
৬) বিআরটিএ-তে দুর্নীতি বন্ধে ডিজিটালাইজেশন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মালিক-শ্রমিক সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে।
৭) বিকল্প গণপরিবহন ব্যবস্থা যেমন মেট্রোরেল, লাইট রেল, এবং ওয়াকেবল ও বাইকেবল শহর গড়তে সরকারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনা কোনো দৈব ঘটনা নয়-এটি আমাদের দীর্ঘদিনের অবহেলা, ব্যর্থতা ও অসচেতনতার ফসল। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে দায় আছে রাষ্ট্রের, সমাজের, পরিবারের এবং ব্যক্তির। নিরাপদ সড়ক একটি মানবাধিকার। এটি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং নাগরিকদেরও একটি নৈতিক দায়িত্ব।
আসুন, মৃত্যুর এই সড়কযাত্রাকে প্রতিরোধ করি-সচেতনতা, আইন প্রয়োগ, প্রযুক্তি এবং সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে। নিরাপদ সড়ক চাই শুধু একটি স্লোগান নয়-এটি এখন বেঁচে থাকার শর্ত।
লেখকঃকলামিস্ট,সোস্যাল এক্টিভিস্ট, মহাসচিব-নিরাপদ সড়ক চাই
E-mail: smazadh@yahoo.com